ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

আমার এমন বিশ্বাস আছে যে, গোবিন্দলালের মাতা যদি পাকা গৃহিণী হইতেন, তবে ফুৎকার মাত্রে এ কালো মেঘ উড়িয়া যাইত। তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, বধূর সঙ্গে তাঁহার পুত্রের আন্তরিক বিচ্ছেদ হইয়াছে। স্ত্রীলোক ইহা সহজেই বুঝিতে পারে। যদি তিনি এই সময়ে সদুপদেশে, স্নেহবাক্যে এবং স্ত্রীবুদ্ধিসুলভ অন্যান্য সদুপায়ে তাহার প্রতীকার করিতে যত্ন করিতেন, তাহা হইলে বুঝি সফল ফলাইতে পারিতেন। কিন্তু গোবিন্দলালের মাতা বড় পাকা গৃহিণী নহেন, বিশেষ পুত্রবধূ বিষয়ের অধিকারিণী হইয়াছে বলিয়া ভ্রমরের উপরে একটু বিদ্বেষাপন্নাও হইয়াছিলেন। যে স্নেহের বলে তিনি ভ্রমরের ইষ্টকামনা করিবেন, ভ্রমরের উপর তাঁহার সে স্নেহ ছিল না। পুত্র থাকিতে পুত্রবধূর বিষয় হইল, ইহা তাঁহার অসহ্য হইল। তিনি একবারও অনুভব করিতে পারিলেন না যে, ভ্রমর গোবিন্দলাল অভিন্নসম্পত্তি জানিয়া, গোবিন্দলালের চরিত্রদোষসম্ভাবনা দেখিয়া, কৃষ্ণকান্ত রায় গোবিন্দলালের শাসন জন্য ভ্রমরকে বিষয় দিয়া গিয়াছিলেন। একবারও তিনি মনে ভাবিলেন না যে, কৃষ্ণকান্ত মুমূর্ষু অবস্থায় কতকটা লুপ্তবুদ্ধি হইয়া, কতকটা ভ্রান্তচিত্ত হইয়াই এ অবিধেয় কার্য করিয়াছিলেন। তিনি ভাবিলেন যে, পুত্রবধূর সংসারে তাঁহাকে কেবল গ্রাসাচ্ছদনের অধিকারিণী, এবং অন্নদাস পৌরবর্গের মধ্যে গণ্যা হইয়া ইহজীবন নির্বাহ করিতে হইবে। অতএব সংসার ত্যাগ করাই ভাল, স্থির করিলেন। একে পতিহীনা, কিছু আত্মপরায়ণা, তিনি স্বামিবিয়োগকাল হইতেই কাশীযাত্রা কামনা করিতেন, কেবল স্ত্রীস্বভাবসুলভ পুত্রস্নেহবশতঃ এতদিন যাইতে পারেন নাই। এক্ষণে যে বাসনা আরও প্রবল হইল।

তিনি গোবিন্দলালকে বলিলেন, “কর্তারা একে একে স্বর্গারোহণ করিলেন, এখন আমার সময় নিকট হইয়া আসিল। তুমি পুত্রের কাজ কর; এই সময় আমাকে কাশী পাঠাইয়া দাও।”

গোবিন্দলাল হঠাৎ এ প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। বলিলেন, “চল, আমি তোমাকে আপনি কাশী রাখিয়া আসিব।” দুর্ভাগ্যবশতঃ এই সময়ে ভ্রমর একবার ইচ্ছা করিয়া পিত্রালয়ে গিয়াছিলেন। কেহই তাঁহাকে নিষেধ করে নাই। অতএব ভ্রমরের অজ্ঞাতে গোবিন্দলাল কাশীযাত্রার সকল উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।নিজ নামে কিছু সম্পত্তি ছিল—তাহা গোপনে বিক্রয় করিয়া অর্থসঞ্চয় করিলেন। কাঞ্চন হীরকাদি মূল্যবান বস্তু যাহা নিজের সম্পত্তি ছিল–তাহা বিক্রয় করিলেন। এইরূপে প্রায় লক্ষ টাকা সংগ্রহ হইল। গোবিন্দলাল ইহা দ্বারা ভবিষ্যতে দিনপাত করিবেন স্থির করিলেন।

তখন মাতৃসঙ্গে কাশীযাত্রার দিন স্থির করিয়া ভ্রমরকে আনিতে পাঠাইলেন। শাশুড়ী কাশীযাত্রা করিবেন শুনিয়া ভ্রমর তাড়াতাড়ি আসিল। আসিয়া শাশুড়ীর চরণ ধরিয়া অনেক বিনয় করিল; শাশুড়ীর পদপ্রান্তে পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল, “মা, আমি বালিকা–আমায় একা রাখিয়া যাইও না–আমি সংসারধর্মের কি বুঝি? মা–সংসার সমুদ্র, আমাকে এ সমুদ্রে একা ভাসাইয়া যাইও না।” শাশুড়ী বলিলেন, “তোমার বড় ননদ রহিল। সেই তোমাকে আমার মত যত্ন করিবে–আর তুমিও গৃহিণী হইয়াছ।” ভ্রমর কিছুই বুঝিল না–কেবল কাঁদিতে লাগিল।

ভ্রমর দেখিল বড় বিপদ সম্মুখে। শাশুড়ী ত্যাগ করিয়া চলিলেন–আবার স্বামীও তাঁহাকে রাখিতে চলিলেন–তিনিও রাখিতে গিয়া বুঝি আর না আইসেন! ভ্রমর গোবিন্দলালের পায়ে ধরিয়া কাঁদিতে লাগিল–বলিল, “কত দিনে আসিবে বলিয়া যাও।”

গোবিন্দলাল বলিলেন, “বলিতে পারি না। আসিতে বড় ইচ্ছা নাই।”

ভ্রমর পা ছাড়িয়া দিয়া উঠিয়া, মনে ভাবিল, “ভয় কি? বিষ খাইব।”
তার পরে স্থিরীকৃত যাত্রার দিবস আসিয়া উপস্থিত হইল। হরিদ্রাগ্রাম হইতে কিছু দূর শিবিকারোহণে গিয়া ট্রেন পাইতে হইবে। শুভ যাত্রিক লগ্ন উপস্থিত–সকল প্রস্তুত। ভারে ভারে সিন্দুক, তোরঙ্গ, বাক্স, বেগ, গাঁটরি বাহকেরা বহিতে আরম্ভ করিল। দাস দাসী সুবিমল ধৌতবস্ত্র পরিয়া, কেশ রঞ্জিত করিয়া, দরওয়াজার সম্মুখে দাঁড়াইয়া পান চিবাইতে লাগিল–তাহারা সঙ্গে যাইবে। দ্বারবানেরা ছিটের জামার বন্ধক আঁটিয়া লাঠি হাতে করিয়া, বাহকদিগের সঙ্গে বকাবকি আরম্ভ করিল। পাড়ার মেয়ে-ছেলে দেখিবার জন্য ঝুঁকিল। গোবিন্দলালের মাতা গৃহদেবতাকে প্রণাম করিয়া, পৌরজন সকলকে যথাযোগ্য সম্ভাষণ করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে শিবিকারোহণ করিলেন; পৌরজন সকলেই কাঁদিতে লাগিল। তিনি শিবিকারোহণ করিয়া অগ্রসর হইলেন।

এদিকে গোবিন্দলাল অন্যান্য পৌরস্ত্রীগণকে যথোচিত সম্বোধন করিয়া শয়নগৃহে রোরুদ্যামানা ভ্রমরের কাছে বিদায় হইতে গেলেন। ভ্রমরকে রোদনবিবশা দেখিয়া তিনি যাহা বলিতে আসিয়াছিলেন, তাহা বলিতে না পারিয়া, কেবল বলিলেন, “ভ্রমর! আমি মাকে রাখিতে চলিলাম।”

ভ্রমর চক্ষের জল মুছিয়া বলিল, “মা সেখানে বাস করিবেন। তুমি আসিবে না কি?”

কথা যখন ভ্রমর জিজ্ঞাসা করিল, তখন তাহার চক্ষের জল শুকাইয়া গিয়াছিল; তাহার স্বরের স্থৈর্য, গাম্ভীর্য, তাহার অধরে স্থির প্রতিজ্ঞা দেখিয়া গোবিন্দলাল কিছু বিস্মিত হইলেন। হঠাৎ উত্তর করিতে পারিলেন না। ভ্রমর স্বামীকে নীরব দেখিয়া পুনরপি বলিল, “দেখ তুমিই আমাকে শিখাইয়াছ, সত্যই আমার ধর্ম, সত্যই একমাত্র সুখ। আজি আমাকে তুমি সত্য বলিও–আমি তোমার আশ্রিত বালিকা–আমায় আজি প্রবঞ্চনা করিও না–কবে আসিবে?”

গোবিন্দলাল বলিলেন, “তবে সত্যই শোন। ফিরিয়া আসিবার ইচ্ছা নাই।”

ভ্রমর। কেন ইচ্ছা নাই–তাহা বলিয়া যাইবে না কি?

গো। এখানে থাকিলে তোমার অন্নদাস হইয়া থাকিতে হইবে।

ভ্রমর। তাহাতেই বা ক্ষতি কি? আমি ত তোমার দাসানুদাসী।

গো। আমার দাসানুদাসী ভ্রমর, আমার প্রবাস হইতে আসার প্রতীক্ষায় জানেলায় বসিয়া থাকিবে। তেমন সময়ে সে পিত্রালয়ে গিয়া বসিয়া থাকে না।

ভ্রমর। তাহার জন্য কত পায়ে ধরিয়াছি–এক অপরাধ কি মার্জনা হয় না!

গো। এখন সেরূপ শত অপরাধ হইবে। তুমি এখন বিষয়ের অধিকারিণী।

ভ্রমর। তা নয়। আমি এবার বাপের বাড়ী গিয়া, বাপের সাহায্যে যাহা করিয়াছি, তাহা দেখ।

এই বলিয়া ভ্রমর একখানা কাগজ দেখাইলেন। গোবিন্দলালের হাতে তাহা দিয়া বলিলেন, “পড়।”

গোবিন্দলাল পড়িয়া দেখিলেন–দানপত্র। ভ্রমর, উচিত মূল্যের ষ্ট্যাম্পে, আপনার সমুদয় সম্পত্তি স্বামীকে দান করিতেছেন–তাহা রেজিষ্টারী হইয়াছে। গোবিন্দলাল পড়িয়া বলিলেন, “তোমার যোগ্য কাজ তুমি করিয়াছ। কিন্তু তোমায় আমায় কি সম্বন্ধ? আমি তোমায় অলঙ্কার দিব, তুমি পরিবে। তুমি বিষয় দান করিবে, আমি ভোগ করিব–এ সম্বন্ধ নহে।” এই বলিয়া গোবিন্দলাল বহুমূল্য দানপত্রখানি খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলেন।

ভ্রমর বলিলেন, “পিতা বলিয়া দিয়াছেন, ইহা ছিঁড়িয়া ফেলা বৃথা। সরকারীতে ইহার নকল আছে।”

গো। থাকে থাক। আমি চলিলাম।

ভ্র। কবে আসিবে?
গো। আসিব না।

ভ্র। কেন? আমি তোমার স্ত্রী, শিষ্যা, আশ্রিতা, প্রতিপালিতা–তোমার দাসানুদাসী–তোমার কথার ভিখারী–আসিবে না কেন?

গো। ইচ্ছা নাই।

ভ্র। ধর্ম নাই কি?

গো। বুঝি আমার তাও নাই।

বড় কষ্টে ভ্রমর চক্ষের জল রোধ করিল। হুকুমে চক্ষের জল ফিরিল–ভ্রমর জোড়হাত করিয়া অবিকম্পিত কণ্ঠে বলিতে লাগিল, “তবে যাও–পার, আসিও না। বিনাপরাধে আমাকে ত্যাগ করিতে চাও, কর।–কিন্তু মনে রাখিও, উপরে দেবতা আছেন। মনে রাখিও–এক দিন আমার জন্য তোমাকে কাঁদিতে হইবে। মনে রাখিও–এক দিন তুমি খুঁজিবে, এ পৃথিবীতে অকৃত্রিম আন্তরিক স্নেহ কোথায় যায়?–দেবতা সাক্ষী! যদি আমি সতী হই, কায়মনোবাক্যে তোমার পায়ে আমার ভক্তি থাকে, তবে তোমায় আমায় আবার সাক্ষাৎ হইবে।অমি সেই আশায় প্রান রাখিব। এখন যাও, বলিতে ইচ্ছা হয়, বল যে আর আসিব না। কিন্তু আমি বলিতেছি–আবার আসিবে–আবার ভ্রমর বলিয়া ডাকিবে–আবার আমার জন্য কাঁদিবে। যদি এ কথা নিষ্ফল হয়, তবে জানিও–দেবতা মিথ্যা, ধর্ম মিথ্যা, ভ্রমর অসতী! তুমি যাও, আমার দুঃখ নাই! তুমি আমারই–রোহিণীর নও।”

এই বলিয়া ভ্রমর, ভক্তিভাবে স্বামীর চরণে প্রণাম করিয়া গজেন্দ্রগমনে কক্ষান্তরে গমন করিয়া দ্বার রুদ্ধ করিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *