দ্বাবিংশতিতম পরিচ্ছেদ

এখন, ভ্রমরেরও যে জ্বালা, রোহিণীরও সেই জ্বালা। কথা যদি রটিল, রোহিণীর কাণেই বা না উঠিবে কেন? রোহিণী শুনিল, গ্রামে রাষ্ট্র যে, গোবিন্দলাল তাহার গোলাম–সাত হাজার টাকার অলঙ্কার দিয়াছে। কথা যে কোথা হইতে রটিল, তাহা রোহিণী শুনে নাই–কে রটাইল,তাহর কোন তদন্ত করে নাই;একেবারে সিদ্ধান্ত করিল যে, তবে ভ্রমরই রটাইয়াছে,নহিলে এত গায়ের জ্বালা কার? রোহিণী ভাবিল–ভ্রমর আমাকে বড় জ্বালাইল। সে দিন চোর অপবাদ, আজ আবার এই অপবাদ। এ দেশে আর আমি থাকিব না। কিন্তু যাইবার আগে একবার ভ্রমরকে হাড়ে হাড়ে জ্বালাইয়া যাইব।

রোহিণী না পারে এমন কাজই নাই, ইহা তাহার পূর্বপরিচয়ে জানা গিয়াছে। রোহিণী কোন প্রতিবাসিনীর নিকট হইতে একখানি বানারসী সাড়ী ও এক সুট গিল‍‍টির গহনা চাহিয়া আনিল। সন্ধ্যা হইলে, সেইগুলি পুঁটুলি বাঁধিয়া সঙ্গে লইয়া রায়দিগের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল। যথায় ভ্রমর একাকিনী মৃৎশয্যায় শয়ন করিয়া, এক একবার কাঁদিতেছে, এক একবার চক্ষের জল মুছিয়া কড়ি পানে চাহিয়া ভাবিতেছে, তথায় রোহিণী গিয়া পুঁটুলি রাখিয়া উপবেশন করিল। ভ্রমর বিস্মিত হইল–রোহিণীকে দেখিয়া বিষের জ্বালায় তাহার সর্বঙ্গ জ্বলিয়া গেল। সহিতে না পারিয়া ভ্রমর বলিল, “তুমি সেদিন রাত্রে ঠাকুরের ঘরে চুরি করিতে আসিয়াছিলে? আজ রাত্রে কি আমার ঘরে সেই অভিপ্রায়ে আসিয়াছ না কি?”

রোহিণী মনে মনে বলিল যে, তোমার মুণ্ডপাত করিতে আসিয়াছি। প্রকাশ্যে বলিল, “এখন আর আমার চুরির প্রয়োজন নাই; আমি আর টাকার কাঙ্গাল নহি। মেজ বাবুর অনুগ্রহে, আমার আর খাইবার পরিবার দুঃখ নাই। তবে লোকে যতটা বলে, ততটা নহে।”

ভ্রমর বলিল, “তুমি এখান হইতে দূর হও।”

রোহিণী সে কথা কাণে না তুলিয়া বলিতে লাগিল, “লোকে যতটা বলে, ততটা নহে। লোকে বলে, আমি সাত হাজার টাকা গহনা পাইয়াছি। মোটে তিন হাজার টাকার গহনা, আর এই সাড়ীখানি পাইয়াছি। তাই তোমায় দেখাইতে আসিয়াছি। সাত হাজার টাকা লোকে বলে কেন?”

এই বলিয়া রোহিণী পুঁটুলি খুলিয়া বানারসী সাড়ী ও গিল্ে‍টির গহনাগুলি ভ্রমরকে দেখাইল। ভ্রমর লাথি মারিয়া অলঙ্কারগুলি চারিদিকে ছড়াইয়া দিল।

রোহিণী বলিল, “সোণায় পা দিতে নাই।” এই বলিয়া রোহিণী নিঃশব্ধে গিল্ ‍টির অলঙ্কারগুলি একে একে কুড়াইয়া আবার পুঁটুলি বাঁধিল। পুঁটুলি বাঁধিয়া, নিঃশব্ধে সেখান হইতে বাহির হইয়া গেল।

আমাদের বড় দুঃখ হইল। ভ্রমর ক্ষীরোদাকে পিটিয়া দিয়াছিল, কিন্তু রোহিণীকে একটি কিলও মারিল না, এই আমাদের আন্তরিক দুঃখ। আমাদের পাঠিকারা উপস্থিত থাকিলে, রোহিণীকে যে স্বহস্তে প্রহার করিতেন, তদ্ে‍বিষয়ে আমাদিগের কোন সংশয় নাই। স্ত্রীলোকের গায়ে হাত তুলিতে নাই, এ কথা মানি। কিন্তু রাক্ষসী বা পিশাচীর গায়ে যে হাত তুলিতে নাই, এ কথা তত মানি না। তবে ভ্রমর যে রোহিণীকে কেন মারিল না, তাহা বুঝাইতে পারি। ভ্রমর ক্ষীরোদাকে ভালবাসিত, সেই জন্য তাহাকে মারপিট করিয়াছিল। রোহিণীকে ভালবাসিত না, এজন্য হাত উঠিল না। ছেলেয় ছেলেয় ঝগড়া করিলে জননী আপনার ছেলেটিকে মারে, পরের ছেলেটিকে মারে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *