চতুর্থ পরিচ্ছেদ

মাধবীনাথ হাসিতে হাসিতে ফিরিয়া আসিলেন। মাধবীনাথ, গোবিন্দলাল ও রোহিনীর অধ:পতনকাহিনী সকলই লোকপরম্পরায় শুনিয়াছিলেন। তিনি মনে মনে স্থিরসিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে, রোহিণী গোবিন্দলাল এক স্থানেই গোপনে বাস করিতেছে। ব্রহ্মানন্দের অবস্থাও তিনি সবিশেষ অবগত ছিলেন–জানিতেন যে,রোহিনী ভিন্ন তাঁহার আর কেহই নাই। অতএব যখন পোষ্ট আপিসে জানিলেন যে ব্রহ্মানন্দের নামে মাসে মাসে রেজিষ্টরি হইয়া চিঠি আসিতেছে–তখন বুঝিলেন যে, হয় রোহিণী, নয় গোবিন্দলাল তাঁহাকে মাসে মাসে খরচ পাঠায়। প্রসাদপুর হইতে চিঠি আসে, অতএব উভয়েই প্রসাদপুরে কিম্বা তাহার নিকটবর্তী কোন স্থানে অবশ্য বাস করিতেছে, কিন্তু নিশ্চয়কে নিশ্চয়তর করিবার জন্য তিনি কন্যালয়ে প্রত্যাগমন করিয়াই ফাঁড়িতে একটি লোক পাঠাইলেন। সাব্ ইন্স্পে ক্টরকে লিখিয়া পাঠাইলেন, একটি কনস্টেড়বল পাঠাইবেন, বোধ হয় কতকগুলি চোরা মাল ধরাইয়া দিতে পারিব।

সাব ইনস্পেক্টর মাধবীনাথকে বিলক্ষণ জানিতেন–ভয়ও করিতেন–পত্রপ্রাপ্তি মাত্র নিদ্রাসিংহ কনস্টেনবলকে পাঠাইয়া দিলেন।

মাধবীনাথ নিদ্রাসিংহের হস্তে দুইটি টাকা দিয়া বলিলেন, “বাপু হে–হিন্দি মিন্দি কইও না–যা বলি, তাই কর। ঐ গাছতলায় গিয়া, লুকাইয়া থাক। কিন্তু এমন ভাবে গাছতলায় দাঁড়াইবে, যেন এখান হইতে তোমাকে দেখা যায়। আর কিছু করিতে হইবে না।” নিদ্রাসিংহ স্বীকৃত হইয়া বিদায় লইল। মাধবীনাথ তখন ব্রহ্মানন্দকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। ব্রহ্মানন্দ আসিয়া নিকটে বসিল। তখন আর কেহ সেখানে ছিল না।

পরস্পরে স্বাগত জিজ্ঞাসার পর মাধবীনাথ বলিলেন, “মহাশয় আমার স্বর্গীয় বৈবাহিক মহাশয়ের বড় আত্মীয় ছিলেন। এখন তাঁহারা ত কেহ নাই–আমার জামাতাও বিদেশস্থ। আপনার কোন বিপদ আপদ পড়িলেই আমাদিগকেই দেখিতে হয়–তাই আপনাকে ডাকাইয়াছি।”

ব্রহ্মানন্দের মুখ শুকাইল। বলিল, “বিপদ কি মহাশয়?” মাধবীনাথ গম্ভীরভাবে বলিলেন, “আপনি কিছু বিপদগ্র্স্ত বটে।”

ব্র। “কি বিপদ্ মহাশয়?”

মা। বিপদ্ সমূহ। পুলিসে কি প্রকারে নিশ্চয় জানিয়াছে যে, আপনার কাছে একখানা চোরা নোট আছে।

ব্রহ্মানন্দ আকাশ হইতে পড়িল। “সে কি! আমার কাছে চোরা নোট!”

মা। তোমার জানা, চোরা না হইতে পারে। অন্যে তোমাকে চোরা নোট দিয়াছে, তুমি না জানিয়া তুলিয়া রাখিয়াছ!

ব্র। সে কি মহাশয়! আমাকে নোট কে দিবে?

মাধবীনাথ তখন আওয়াজ ছোট করিয়া বলিলেন, “আমি সকলই জানিয়াছি–পুলিসেও জানিয়াছে। বাস্তবিক পুলিসের কাছেই এ কথা শুনিয়াছি। চোরা নোট প্রসাদপুর হইতে আসিয়াছে। ঐ দেখ একজন পুলিসের কনস্টেেবল আসিয়া তোমার জন্য দাঁড়াইয়া আছে–আমি তাহাকে কিছু দিয়া আপাততঃ স্থগিত রাখিয়াছি |”

মাধবীনাথ তখন বৃক্ষতলবিহারী রুলধারী গুম্ফশ্মশ্রু-শোভিত জলধরসন্নিভ কনস্টেঃবলের কান্তমূতি দর্শন করাইলেন।

ব্রহ্মানন্দ থর থর কাঁপিতে লাগিল। মাধবীনাথের পায়ে জড়াইয়া কাঁদিয়া বলিল, “আপনি রক্ষা করুন।”

মা। ভয় নাই। এবার প্রসাদপুর হইতে কোন্ কোন্ নম্বরের নোট পাইয়াছ, বল দেখি। পুলিসের লোক আমার কাছে নোটের নম্বর রাখিয়া গিয়াছে। যদি সে নম্বরের নোট না হয়, তবে ভয় কি? নম্বর বদলাইতে কতক্ষণ? এবারকার প্রসাদপুরের পত্রখানি লইয়া আইস দেখি–নোটের নম্বর দেখি।
ব্রহ্মানন্দ যায় কি প্রকারে? ভয় করে–কনস্টেেবল যে গাছতলায়।

মাধবীনাথ বলিলেন, “কোন ভয় নাই, আমি সঙ্গে লোক দিতেছি।” মাধবীনাথের আদেশমত একজন দ্বারবান ব্রহ্মানন্দের সঙ্গে গেল। ব্রহ্মানন্দ রোহিণীর পত্র লইয়া আসিলেন। সেই পত্রে, মাধবীনাথ যাহা যাহা খুঁজিতেছিলেন, সকলই পাইলেন।

পত্র পাঠ করিয়া ব্রহ্মানন্দকে ফিরাইয়া দিয়া বলিলেন, “এ নম্বরের নোট নহে। কোন ভয় নাই–তুমি ঘরে যাও। আমি কনস্টে বলকে বিদায় করিয়া দিতেছি।”

ব্রহ্মানন্দ মৃতদেহে প্রাণ পাইল। উর্ধ্বশ্বাসে তথা হইতে পলায়ন করিল।

মাধবীনাথ কন্যাকে চিকিৎসার্থ স্বগৃহে লইয়া গেলেন। তাহার চিকিৎসার্থ উপযুক্ত চিকিৎসক নিযুক্ত করিয়া দিয়া, স্বয়ং কলিকাতায় চলিলেন। ভ্রমর অনেক আপত্তি করিল, মাধবীনাথ শুনিলেন না। শীঘ্রই আসিতেছি, এই বলিয়া কন্যাকে প্রবোধ দিয়া গেলেন।

কলিকাতায় নিশাকর দাস নামে মাধবীনাথের একজন বড় আত্মীয় ছিলেন। নিশাকর মাধবীনাথের অপেক্ষা আট দশ বৎসরের বয়ঃকনিষ্ঠ। নিশাকর কিছু করেন না–পৈতৃক বিষয় আছে–কেবল একটু একটু গীতবাদ্যের অনুশীলন করেন। নিষ্কর্মা বলিয়া সর্বদা পর্য্যটনে গমন করিয়া থাকেন। মাধবীনাথ তাঁহার কাছে আসিয়া সাক্ষাৎ করিলেন। অন্যান্য কথার পর নিশাকরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন হে, বেড়াইতে যাইবে?”

নিশা। কোথায়?

মা। যশোর।

নি। সেখানে কেন?

মা। নীলকুঠি কিন‍ব।

নি। চল।

তখন বিহিত উদ্যোগ করিয়া দুই বন্ধু এক দিনের মধ্যে যশোরাভিমুখে যাত্রা করিলেন। সেখান হইতে প্রসাদপুর যাইবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *