পঞ্চম পরিচ্ছেদ

তখন দুই জনে কাণে কাণে কি পরামর্শ করিলেন। পরামর্শ করিয়া জীবানন্দ এক বনে লুকাইলেন। শান্তি আর এক বনে প্রবেশ করিয়া এক অদ্ভুত রহস্যে প্রবৃত্ত হইল।
শান্তি মরিতে যাইতেছিল, কিন্তু মৃত্যুকালে স্ত্রীবেশ ধরিবে, ইহা স্থির করিয়াছিল। তাহার এ পুরুষবেশ জুয়াচুরি, মহেন্দ্র বলিয়াছে। জুয়াচুরি করিতে করিতে মরা হইবে না। সুতরাং ঝাঁপি টেপারিটি সঙ্গে আনিয়াছিলেন। তাহাতে তাহার সজ্জাসকল থাকিত। এখন নবীনানন্দ ঝাঁপি টেপারি খুলিয়া বেশপরিবর্তনে প্রবৃত্ত হইল।
চিকণ রকম রসকলির উপর খয়েরের টিপ কাটিয়া তৎকালপ্রচলিত ফুরফুরে কোঁকড়া কোঁকড়া কতকগুলি ঝাপটার গোছায় চাঁদমুখখানি ঢাকিয়া, শান্তি একটি সারঙ্গ হস্তে বৈষ্ণবীবেশে ইংরেজ – শিবিরে দর্শন দিল। দেখিয়া ভ্রমরকৃষ্ণশ্মশ্রুযুক্ত সিপাহীরা বড় মাতিয়া গেল। কেহ টপ্পা, কেহ গজল, কেহ শ্যামাবিষয়, কেহ ফরমাস করিয়া শুনিল। কেহ চাল দিল, কেহ ডাল দিল, কেহ মিষ্টি দিল, কেহ পয়সা দিল, কেহ সিকি দিল। বৈষ্ণবী তখন শিবিরের অবস্থা স্বচক্ষে সবিশেষ দেখিয়া চলিয়া যায় ; সিপাহীরা জিজ্ঞাসা করিল, “আবার কবে আসিবে?” বৈষ্ণবী বলিল, “তা জানি না, আমার বাড়ী ঢের দূর।” সিপাহীরা জিজ্ঞাসা করিল, “কত দূর?” বৈষ্ণবী বলিল, “আমার বাড়ী পদচিহ্নে।” এখন সেই দিন মেজর সাহেব পদচিহ্নের কিছু খবর লইতেছিলেন। একজন সিপাহী তাহা জানিত। বৈষ্ণবীকে ডাকিয়া কাপ্তেন সাহেবের কাছে লইয়া গেল। কাপ্তেন সাহেব তাহাকে মেজর সাহেবের কাছে লইয়া গেল। মেজর সাহেবের কাছে গিয়া বৈষ্ণবী মধুর হাসি হাসিয়া, মর্মভেদী কটাক্ষে সাহেবের মাথা ঘুরাইয়া দিয়া, খঞ্জনীতে আঘাত করিয়া গান ধরিল –

“ম্লেচ্ছনিবহনিধনে কলয়সি করবালম্।”

সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “টোমাড় বাড়ী কোঠা বিবি?”
বৈষ্ণবী বলিল, “আমি বিবি নাই, বৈষ্ণবী। বাড়ী পদচিহ্নে |”
সাহেব। Well that is Padsin – Padsin is it? হুঁয়া একটো গর হ্যায়?
বৈষ্ণবী বলিল, “ঘর? – কত ঘর আছে |”
সা। গর নেই,-গর নেই,- গর, – গর-
শা। সাহেব, তোমার মনের কথা বুঝেছি। গড়?
সা। ইয়েস ইয়েস, গর! গর! – হ্যায়?
শা। গড় আছে। ভারি কেল্লা।
সা। কেট্টে আডমি?
শা। গড়ে কত লোক থাকে? বিশ পঞ্চাশ হাজার।
সা। নন্সেন্স। একটো কেল্লেমে ডো চার হাজার রহে শক্তা। হুঁয়া পর আবি হ্যায়? ইয়া নিকেল গিয়া?
শা। আবার নেকলাবে কোথা?
সা। মেলামে – টোম কব আয়া হ্যায় হুঁয়াসে?
শা। কাল এসেছি সায়েব।
সা। ও লোক আজ নিকেল গিয়া হোগা।
শান্তি মনে মনে ভাবিতেছিল যে, “তোমার বাপের শ্রাদ্ধের চাল যদি আমি না চড়াই, তবে আমার রসকলি কাটাই বৃথা। কতক্ষণে শিয়ালে তোমার মুণ্ড খাবে আমি দেখব।” প্রকাশ্যে বলিল, “তা সাহেব, হতে পারে, আজ বেরিয়ে গেলে যেতে পারে। অত খবর আমি জানি না, বৈষ্ণবী মানুষ, গান গেয়ে ভিক্ষা শিক্ষা করে খাই, অত খবর রাখি নে। বকে বকে গলা শুকিয়ে উঠ‍ল, পয়সাটা সিকেটা দাও – উঠে চলে যাই। আর ভাল করে বখশিশ দাও ত না হয় পরশু এসে বলে যাব |”
সাহেব ঝনাৎ করিয়া একটা নগদ টাকা ফেলিয়া দিয়া বলিল, “পরশু নেহি বিবি!”
শান্তি বলিল, “দূর বেটা! বৈষ্ণবী বল্, বিবি কি?”
এডওয়ার্ড‍স। পরশু নেহি, আজ রাৎকো হামকো খবর মিল‍না চাহিয়ে।
শা। বন্দুক মাথায় দিয়ে সরাপ টেনে সরষের তেল নাকে দিয়ে ঘুমো। আজ আমি দশ কোশ রাস্তা যাব – আসব –ওঁকে খবর এনে দেব! ছুঁচো বেটা কোথাকার।
এ। ছুঁচো ব্যাটা কেস্কা কয়তা হ্যায়?
শা। যে বড় বীর – ভারি জাঁদরেল।
এ। Great General হাম হো শক্তা হ্যায় – ক্লাইবকা মাফিক। লেকেন আজ হামকো খবর মিলনে চাহিয়ে। শও রূপেয়া বখশিশ দেঙ্গে।
শা। শ-ই দাও আর হাজার দাও, বিশ ক্রোশ এ দুখানা ঠেঙ্গে হবে না।
এ। ঘোড়ে পর।
শা। ঘোড়ায় চড়িতে জানলে আর তোমার তাঁবুতে এসে সারেঙ্গ বাজিয়ে ভিক্ষে করি?
এ। গদী পর লে যায়েগা।
শা। কোলে বসিয়ে নিয়ে যাবে? আমার লজ্জা নাই?
এ। ক্যা মুস্কিল, পানশো রূপেয়া দেঙ্গে।
শা। কে যাবে, তুমি নিজে যাবে?
সাহেব তখন অঙ্গুলিনির্দেশপূর্বক সম্মুখে দণ্ডায়মান লিণ্ডলে নামক একজন যুবা এন‍সাইনকে দেখাইয়া তাহাকে বলিলেন, “লিণ্ডলে, তুমি যাবে?” লিণ্ডলে শান্তির রূপযৌবন দেখিয়া বলিল, “আহ্লাদপূর্বক |”
তখন ভারি একটা আরবী ঘোড়া সজ্জিত হইয়া আসিলে লিণ্ডলেও তৈয়ার হইল। শান্তিকে ধরিয়া ঘোড়ায় তুলিতে গেল। শান্তি বলিল, “ছি, এত লোকের মাঝখানে? আমার কি আর কিছু লজ্জা নাই! আগে চল ছাউনি ছাড়াই |”
লিণ্ডলে ঘোড়ায় চড়িল। ঘোড়া ধীরে ধীরে হাঁটাইয়া চলিল। শান্তি পশ্চাৎ পশ্চাৎ হাঁটিয়া চলিল। এইরূপে তাহারা শিবিরের বাহিরে আসিল। শিবিরের বাহিরে আসিলে নির্জন প্রান্তর পাইয়া, শান্তি লিণ্ডলের পায়ের উপর পা দিয়া এক লাফে ঘোড়ায় চড়িল। লিণ্ডলে হাসিয়া বলিল, “তুমি যে পাকা ঘোড়সওয়ার |”
শান্তি বলিল, “আমরা এমন পাকা ঘোড়সওয়ার যে, তোমার সঙ্গে চড়িতে লজ্জা করে। ছি! রেকাব পায়ে দিয়ে ঘোড়ায় চড়া!”
একবার বড়াই করিবার জন্য লিণ্ডলে রেকাব হইতে পা লইল। শান্তি অমনি নির্বোধ ইংরেজের গলদেশে হস্তার্পণ করিয়া ঘোড়া হইতে ফেলিয়া দিল। শান্তি তখন অশ্বপৃষ্ঠে রীতিমত আসন গ্রহণ করিয়া, ঘোড়ার পেটে মলের ঘা মারিয়া, বায়ুবেগে আরবীকে ছুটাইয়া দিল। শান্তি চারি বৎসর সন্তানসৈন্যের সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়া অশ্বারোহণবিদ্যাও শিখিয়াছিল। তা না শিখিলে জীবানন্দের সঙ্গে কি বাস করিতে পারিত? লিণ্ডলে পা ভাঙ্গিয়া পড়িয়া রহিলেন। শান্তি বায়ুবেগে অশ্বপৃষ্ঠে চলিল।
যে বনে জীবানন্দ লুকাইয়াছিলেন, শান্তি সেইখানে গিয়া জীবানন্দকে সকল সংবাদ অবগত করাইল। জীবানন্দ বলিলেন, “তবে আমি শীঘ্র গিয়া মহেন্দ্রকে সতর্ক করি। তুমি মেলায় গিয়া সত্যানন্দকে খবর দাও। তুমি ঘোড়ায় যাও – প্রভু যেন শীঘ্র সংবাদ পান |” তখন দুই জনে দুই দিকে ধাবিত হইল। বলা বৃথা, শান্তি আবার নবীনানন্দ হইল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *