অষ্টম পরিচ্ছেদ
ব্রজেশ্বর বলিল, “আমি ইংরেজের গায়ে হাত তুলেছি, না ইংরেজ আমার গায়ে হাত তুলিতেছে?”
হরবল্লভ সাহেবকে বলিলেন, “হুজুর! ও ছেলেমানুষ, আজও বুদ্ধিশুদ্ধি হয় নি, আপনি ওর অপরাধ লইবেন না। মাফ করুন।”
সাহেব বলিলেন, “ও বড় বদমাস। তবে যদি আমার কাছে ও জোড়হাত করিয়া মাফ চায়, তবে আমি মাফ করিতে পারি।”
হ। ব্রজ তাই কর। জোড়হাত করিয়া সাহেবকে বল, “আমাকে মাফ করুন।”
ব্র। সাহেব, আমরা হিন্দু, পিতার আজ্ঞা আমরা কখনও লঙ্ঘন করি না। আমি আপনার কাছে জোড়হাত করিয়া ভিক্ষা করিতেছি, আমাকে মাফ করুন।
সাহেব ব্রজেশ্বরের পিতৃভক্তি দেখিয়া প্রসন্ন হইয়া ব্রজেশ্বরকে ক্ষমা করিলেন, আর ব্রজেশ্বরের হাত লইয়া আচ্ছা করিয়া নাড়া দিলেন। ব্রজেশ্বরের চতুর্দশ পুরুষের মধ্যে কখন জানে না, সেকহ্যাকণ্ড কাকে বলে–সুতরাং ব্রজেশ্বর একটু ভেকা হইয়া রহিল। মনে করিল, “কি জানি, যদি আবার বাঁধে।” এই ভাবিয়া ব্রজেশ্বর বাহিরে গিয়া বসিল। কেবল ঝড়, –বৃষ্টি নাই, –ভিজিতে হইল না।
রঙ্গরাজ বাহিরে আসিয়া, কামরার দ্বার বন্ধ করিয়া দ্বারে পিঠ দিয়া বসিল–দুই দিকের পাহারায় বিশেষ, এ সময়ে বাহিরে একটু সতর্ক থাকা ভাল, বজরা বড় তীব্রবেগে যাইতেছে, হঠাৎ বিপদ ঘটাও বিচিত্র নহে।
দিবা উঠিয়া দেবীর কাছে গেল–পুরুষ-মহলে এখন আর প্রয়োজন নাই। নিশি উঠিল না–তার কিছু মতলব ছিল। সর্বস্ব শ্রীকৃষ্ণে অর্পিত–সুতরাং অগাধ সাহস।
সাহেব জাঁকিয়া আবার রূপার চৌকিতে বসিলেন, ভাবিতে লাগিলেন, “ডাকাইতের হাত হইতে কিরূপে মুক্ত হইব? যাহাকে ধরিতে আসিয়াছিলাম, তাহারই কাছে ধরা পড়িলাম–স্ত্রীলোকের কাছে পরাজিত হইলাম, ইংরেজ মহলে আর কি বলিয়া মুখ দেখাইব? আমার না ফিরিয়া যাওয়াই ভাল।”
হরবল্লভ আর বসিবার স্থান না পাইয়া নিশি সুন্দরীর মসনদের কাছে বসিলেন। দেখিয়া নিশি বলিল, “আপনি একটু নিদ্রা যাবেন?”
হ। আজ কি আর নিদ্রা হয়?
নি। আজ না হইল ত আর হইল না।
হ। সে কি?
নি। আবার ঘুমাইবার দিন কবে পাইবেন?
হ। কেন?
নি। আপনি দেবী চৌধুরাণীকে ধরাইয়া দিতে আসিয়াছিলেন?
হ। তা–তা–কি জান–
নি। ধরা পড়িলে দেবীর কি হইত, জান?
হ। আ–এমন কি–
নি। এমন কিছু নয়, ফাঁসি!
হ। তা–না–এই–তা কি জান–
নি। দেবী তোমার কোন অনিষ্ট করে নাই, বরং ভারী উপকার করিয়াছিল–যখন তোমার জাতি যায়, প্রাণ যায়, তখন তোমায় পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ দিয়া, তোমায় রক্ষা করিয়াছিল। তার প্রত্যুপকারে তুমি তাহাকে ফাঁসি দিবার চেষ্টায় ছিলে। তোমার যোগ্য কি দণ্ড বল দেখি?
হরবল্লভ চুপ করিয়া রহিল।
নিশি বলিতে লাগিল, “তাই বলিতেছিলাম, এই বেলা ঘুমাইয়া লও–আর রাত্রের মুখ দেখিবে না। নৌকা কোথায় যাইতেছে বল দেখি?”
হরবল্লভের কথা কহিবার শক্তি নাই।
নিশি বলিতে লাগিল, “ডাকিনীর শ্মশান বলিয়া প্রকাণ্ড শ্মশান আছে। আমরা যাদের প্রাণে মারি, তাদের সেইখানে লইয়া গিয়া মারি। বজরা এখন সেইখানে যাইতেছে। সেইখানে পৌঁছিলে সাহেব ফাঁসি যাইবে, রাণীজির হুকুম হইয়া গিয়াছে। আর তোমায় কি হুকুম করিয়াছে, জান?”
হরবল্লভ কাঁদিতে লাগিল–জোড়হাত করিয়া বলিল, “আমায় রক্ষা কর।”
নিশি বলিল, “তোমায় রক্ষা করিবে, এমন পাষণ্ড পামর কে আছে? তোমায় শূলে দিবার হুকুম হইয়াছে।”
হরবল্লভ ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিল। ঝড়ের শব্দ বড় প্রবল; সে কান্নার শব্দ ব্রজেশ্বর শুনিতে পাইল না–দেবীও না। সাহেব শুনিল। সাহেব কথাগুলা শুনিতে পায় নাই–কান্না শুনিতে পাইল। সাহেব ধমকাইল, “রোও মৎ-উল্লুক মর্নাি এক রোজ আল্বৎ হ্যায়।”
সে কথা কাণে না তুলিয়া নিশির কাছে জোড়হাত করিয়া বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাঁদিতে লাগিল। বলিল, হাঁ গা! আমায় কি কেউ রক্ষা করিতে পারে না গা?”
নি। তোমার মত নরাধমকে বাঁচাইয়া পাতকগ্রস্ত হইবে? আমাদের রাণী দয়ময়ী, কিন্তু তোমার জন্য কেহই তাঁর কাছে দয়ার ভিক্ষা করিব না।
হ। আমি লক্ষ টাকা দিব।
নি। মুখে আনিতে লজ্জা করে না? পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্য এই কৃতঘ্নের কাজ করিয়াছ–আবার লক্ষ টাকা হাঁক?
হ। আমাকে যা বলিবে, তাই করিব।
নি। তোমার মত লোকের দ্বারা কোন্ কাজ হয় যে, তুমি, যা বলিব, তাই করিবে?
হ। অতি ক্ষুদ্রের দ্বারাও উপকার হয়–ওগো, কি করিতে হইবে বল, আমি প্রাণপণ করিয়া করিব–আমায় বাঁচাও।
নি। (ভাবিতে ভাবিতে) তোমার দ্বারাও আমার একটা উপকার হইলে হইতে পারে–তা তোমার মত লোকের দ্বারা সে উপকার না হওয়াই ভাল।
হ। তোমার কাছে জোড়হাত করিতেছি–তোমার হাত ধরিতেছি–
হরবল্লভ বিহ্বল–নিশি ঠাকুরাণীর বাঁউড়ী-পরা গোলগাল হাতখানি প্রায় ধরিয়া ফেলিয়াছিল আর কি! চতুরা নিশি আগে হাত সরাইয়া লইল–বলিল, “সাবধান! ও হাত শ্রীকৃষ্ণের গৃহীত। কিন্তু তোমার হাতে-পায়ে ধরিয়া কাজ নাই–তুমি যদি এতই কাতর হইয়াছ, তবে তুমি যাতে রক্ষা পাও, আমি তা করিতে রাজি হইতেছি। কিন্তু তোমায় যা বলিব, তা যে তুমি করিবে, এ বিশ্বাস হয় না। তুমি জুয়োচোর, কৃতঘ্ন, পামর, গোইন্দাগিরি কর–তোমার কথায় বিশ্বাস কি?”
হ। যে দিব্য বল, সেই দিব্য করিতেছি।
নি। তোমার আবার দিব্য? কি দিব্য করিবে?
হ। গঙ্গাজল তামা তুলসী দাও–আমি স্পর্শ করিয়া দিব্য করিতেছি। নি। ব্রজেশ্বরের মাথায় হাত দিয়া দিব্য করিতে পার?
হরবল্লভ গর্জিয়া উঠিল। বলিল, “তোমাদের যা ইচ্ছা, তাহা কর। আমি তা পারিব না।” কিন্তু এ তেজ ক্ষণিকমাত্র। হরবল্লভ আবার তখনই হাত কচলা্ইতে লাগিল–বলিল, “আর যে দিব্য বল, সেই দিব্য করিব, রক্ষা কর।”
নি। আচ্ছা, দিব্য করিতে হইবে না–তুমি আমাদের হাতে আছ। শোন, আমি বড় কুলীনের মেয়ে। আমাদের ঘরে পাত্র জোটা ভার। আমার একটি পাত্র জুটিয়াছিল, (পাঠক জানেন, সব মিথ্যা) কিন্তু আমার ছোট বহিনের জুটিল না। আজিও তাহার বিবাহ হয় নাই।
হ। বয়স কত হইয়াছে?
নি। পঁচিশ ত্রিশ।
হ। কুলীনের মেয়ে অমন অনেক থাকে।
নি। থাকে, কিন্তু আর তার বিবাহ না হইলে অঘরে পড়িবে, এমন গতিক হইয়াছে। তুমি আমার বাপের পালটি ঘর। তুমি যদি আমার ভগিনীকে বিবাহ কর, আমার বাপের কুল থাকে। আমিও এই কথা বলিয়া রাণীজির কাছে তোমার প্রাণ ভিক্ষা করিয়া লই।
হরবল্লভের মাথার উপর হইতে পাহাড় নামিয়া গেল। আর একটা বিবাহ বৈ ত নয়–সেটা কুলীনের পক্ষে শক্ত কাজ নয়–তা যত বড় মেয়ে হৌক না কেন! নিশি যে উত্তরের প্রত্যাশা করিয়াছিল, হরবল্লভ ঠিক সেই উত্তর দিল, বলিল, “এ আর বড় কথা কি? কুলীনের কুল রাখা কুলীনেরই কাজ। তবে একটা কথা এই, আমি বুড়া হইয়াছি, আমার আর বিবাহের বয়স নাই। আমার ছেলে বিবাহ করিলে হয় না?”
নি। তিনি রাজি হবেন?
হ। আমি বলিলেই হইবে।
নি। তবে আপনি কাল প্রাতে সেই আজ্ঞা দিয়া যাইবেন। তাহা হইলে, আমি পাল্কী বেহারা আনিয়া আপনাকে বাড়ী পাঠাইয়া দিব।
হরবল্লভ হাত বাড়াইয়া স্বর্গ পাইল–কোথায় শূলে যায়–কোথায় বৌভাতের ঘটা। হরবল্লভের আর দেরি সয় না। বলিল, “তবে তুমি গিয়া রাণীজিকে এ সকল কথা জানাও।”
নিশি বলিল, “চলিলাম।” নিশি দ্বিতীয় কামরার ভিতর প্রবেশ করিল।
নিশি গেলে, সাহেব হরবল্লভকে জিজ্ঞাসা করিল, “স্ত্রীলোকটা তোমাকে কি বলিতেছিল?”
হ। এমন কিছুই না।
সা। কাঁদিতেছিলে কেন?
হ। কই? কাঁদি নাই।
সা। বাঙ্গালি এমনই মিথ্যাবাদী বটে।
নি। ভিতরে আসিলে দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “আমার শ্বশুরের সঙ্গে এত কি কথা কহিতেছিলে?”
নি। দেখিলাম, যদি তোমার শাশুড়ীগিরিতে বাহাল হইতে পারি।
দেবী। নিশি ঠাকুরাণি! তোমার মন প্রাণ, জীবন যৌবন সর্বস্ব শ্রীকৃষ্ণে সমর্পণ করিয়াছ–কেবল জুয়াচুরিটুকু নয়। সেটুকু নিজের ব্যবহারের জন্য রাখিয়াছ।
নি। দেবতাকে ভাল সামগ্রীই দিতে হয়। মন্দ সামগ্রী কি দিতে আছে?
দেবী। তুমি নরকে পচিয়া মরিবে।