চতুর্থ পরিচ্ছেদ

দেবী ডাকিল, “নিশি!”

নিশি ছাদের উপর আসিল।

দেবী। কার ভেরী ঐ?

নি। যেন দাড়ি বাবাজীর বলিয়া বোধ হয়।

দেবী। রঙ্গরাজের?

নি। সেই রকম।

দেবী। সে কি? আমি রঙ্গরাজকে প্রাতে দেবীগড় পাঠাইয়াছি।

নি। বোধ হয়, পথ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে।

দেবী। রঙ্গরাজকে ডাক।

ব্রজেশ্বর বলিল, “ভেরীর আওয়াজ অনেক দূর হইতে হইয়াছে। এখান হইতে ডাকিলে ডাক শুনিতে পাইবে না। আমি নামিয়া ভেরীওয়ালাকে খুঁজিয়া আনিতেছি।”

দেবী বলিল, “কিছু করিতে হইবে না। তুমি একটু নীচে গিয়া নিশির কৌশল দেখ।”

নিশি ও ব্রজ নীচে আসিল। নিশি নীচে গিয়া এ বাঁশী বাহির করিল। নিশি গীত বাদ্যে বড় পটু, সে শিক্ষা রাজবাড়ীতে হইয়াছিল। নিশিই দেবীর বীণার ওস্তাদ। নিশি বাঁশীতে ফুঁ দিয়া মল্লারে তান মারিল। অনতিবিলম্বে রঙ্গরাজ বজরায় আসিয়া উঠিয়া দেবীকে আশীর্বাদ করিল।

এই সময়ে ব্রজেশ্বর নিশিকে বলিল, “তুমি ছাদে যাও। তোমার কাছে কেহ বোধ হয়, কথা লুকাইবে না। কি কথা হয়, শুনিয়া আসিয়া আমাকে সব বলিও।”

নিশি স্বীকৃত হইয়া কামরার বাহির হইল–বাহির হইয়া আবার ফিরিয়া আসিয়া ব্রজেশ্বরকে বলিল, “আপনি একটু বাহিরে আসিয়া দেখুন।”

ব্রজেশ্বর মুখ বাড়াইয়া দেখিল। দেখিতে পাইল, জঙ্গলের ভিতর হইতে অগণিত মনুষ্য বাহির হইতেছে। নিশিকে জিজ্ঞাসা করিল, “উহারা কারা? সিপাই?”

নিশি বলিল, “বোধ হয় উহারা বরকউন্দাজ। রঙ্গরাজ আনিয়া থাকিবে।”

দেবীও সেই মনুষ্যশ্রেণী দেখিতেছিল, এমন সময়ে রঙ্গরাজ আসিয়া আশীর্বাদ করিল। দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি এখানে কেন রঙ্গরাজ?”

রঙ্গরাজ প্রথমে কোন উত্তর করিল না। দেবী পুনরপি বলিল, “আমি সকালে তোমাকে দেবীগড় পাঠাইয়াছিলাম। সেখানে যাও নাই কেন? আমার কথা অমান্য করিয়াছ কেন?”

র। আমি দেবীগড় যাইতেছিলাম –পথে ঠাকুরজির সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল।

দেবী। ভবানী ঠাকুর?

র। তাঁর কাছে শুনিলাম, কোম্পানির সিপাহী আপনাকে ধরিতে আসিতেছে। তাই আমরা দুই জনে বরকরন্দাজ সংগ্রহ করিয়া লইয়া আসিয়াছি। বরকহন্দাজ জঙ্গলে লুকাইয়া রাখিয়া আমি তীরে বসিয়াছিলাম। ছিপ আসিতেছে দেখিয়া আমি ভেরী বাজাইয়া সঙ্কেত করিয়াছি।

দেবী। ও জঙ্গলেও সিপাহী আছে?

র। তাহাদের আমরা ঘেরিয়া ফেলিয়াছি।

দেবী। ঠাকুরজি কোথায়?

র। ঐ বরকন্দাজ লইয়া বাহির হইতেছেন।

দেবী। তোমরা কত বরকন্দাজ আনিয়াছ?

র। প্রায় হাজার হইবে।

দেবী। সিপাহী কত?

র। শুনিয়াছি পাঁচ শ।

দেবী। এই পনের শ লোকের লড়াই হইলে, মরিবে কত?

র। তা দুই চারি শ মরিলেও মরিতে পারে।

দেবী। ঠাকুরজিকে গিয়া বল–তুমিও শোন যে, তোমাদের এই আচরণে আমি আজ মর্মান্তিক মনঃপীড়া পাইলাম।

র। কেন, মা?

দেবী। একটা মেয়েমানুষের প্রাণের জন্য এত লোক তোমরা মারিবার বাসনা করিয়াছ–তোমাদের কি কিছু ধর্মজ্ঞান নাই? আমার পরমায়ু শেষ হইয়া থাকে, আমি একা মরিব– আমার জন্য চারি শ লোক কেন মরিবে? আমায় কি তোমরা এমন অপদার্থ ভাবিয়াছ যে, আমি এত লোকের প্রাণ নষ্ট করিয়া আপনার প্রাণ বাঁচাইব?

র। আপনি বাঁচিলে অনেক লোকের প্রাণরক্ষা হইবে।

দেবী রাগে, ঘৃণায় অধীর হইয়া বলিল, “ছি! সেই ধিক্কারে রঙ্গরাজ অধোবদন হইল–মনে করিল, “পৃথিবী দ্বিধা হউক, আমি প্রবেশ করি।”

দেবী তখন বিস্ফারিত নয়নে, ঘৃণাস্ফুরিত কম্পিতাধরে বলিতে লাগিল, “শোন, রঙ্গরাজ! ঠাকুরজিকে গিয়া বল, এই মুহূর্ত্তে বরকন্দাজ সকল ফিরাইয়া লইয়া যাউন। তিলার্দ্ধ বিলম্ব হইলে, আমি এই জলে ঝাঁপ দিয়া মরিব, তোমরা কেহ রাখিতে পারিবে না।”

রঙ্গরাজ এতটুকু হইয়া গেল। বলিল, “আমি চলিলাম। ঠাকুরজিকে এই সকল কথা জানাইব। তিনি যাহা ভাল বুঝিবেন, তাহা করিবেন। আমি উভয়েরই আজ্ঞাকারী।”

রঙ্গরাজ চলিয়া গেল। নিশি ছাদে দাঁড়াইয়া সব শুনিয়াছিল। রঙ্গরাজ গেলে, সে দেবীকে বলিল, “ভাল, তোমার প্রাণ লইয়া তুমি যাহা ইচ্ছা করিতে পার, তাহারও নিষেধ করিবার অধিকার নাই। কিন্তু আজি তোমার সঙ্গে তোমার স্বামী–তাঁর জন্যেও ভাবিলে না?”

দেবী। ভাবিয়াছি ভগিনি! ভাবিয়া কিছু করিতে পারি নাই। জগদীশ্বর মাত্র ভরসা। যা হইবার, হইবে। কিন্তু যাই হউক নিশি–এক কথা সার। আমার স্বামীর প্রাণ বাঁচাইবার জন্য এত লোকের প্রাণ নষ্ট করিবার আমার কোন অধিকার নাই। আমার স্বামী আমার বড় আদরের–তাদের কে?

নিশি মনে মনে দেবীকে ধন্য ধন্য করিল। ভাবিল, “এই সার্থক নিষ্কাম ধর্ম শিখিয়াছিল। ইহার সঙ্গে মরিয়াও সুখ।”

নিশি গিয়া, সকল কথা ব্রজেশ্বরকে শুনাইল। ব্রজেশ্বর প্রফুল্লকে আর আপনার স্ত্রী বলিয়া ভাবিতে পারিল না; মনে মনে বলিল, “যথার্থ দেবীই বটে। আমি নরাধম! আমি আবার ইহাকে ডাকাইত বলিয়া ভর্ৎসনা করিতে গিয়াছিলাম।”

এদিকে পাঁচ দিক হইতে পাঁচখানা ছিপ আসিয়া বজরার অতি নিকটবর্তী হইল। প্রফুল্ল সেদিকে দৃকপাতও করিল না, প্রস্তরময়ী মূর্ত্তির মত নিস্পন্দ শরীরে ছাদের উপর বসিয়া রহিল। প্রফুল্ল ছিপ দেখিতেছিল না–বর্ককন্দাজ দেখিতেছিল না। দূর আকাশপ্রান্তে তাহার দৃষ্টি। আকাশপ্রান্তে একখানা ছোট মেঘ, অনেক ক্ষণ হইতে দেখা দিয়াছিল। প্রফুল্ল তাই দেখিতেছিল। দেখিতে দেখিতে বোধ হইল, যেন সেখানা একটু বাড়িল; তখন “জয় জগদীশ্বর!” বলিয়া প্রফুল্ল ছাদ হইতে নামিল।

প্রফুল্লকে ভিতরে আসিতে দেখিয়া, নিশি জিজ্ঞাসা করিল, “এখন কি করিবে?”

প্রফুল্ল বলিল, “আমার স্বামীকে বাঁচাইব।”

নি। আর তুমি?

দেবী। আমার কথা আর জিজ্ঞাসা করিও না। আমি যাহা বলি, যাহা করি, এখন তাহাতে বড় সাবধানে মনোযোগ দাও। তোমার আমার অদৃষ্টে যাই হৌক, আমার স্বামীকে বাঁচাইতে হইবে, দিবাকে বাঁচাইতে হইবে, শ্বশুরকে বাঁচাইতে হইবে।

এই বলিয়া দেবী একটা শাঁক লইয়া ফুঁ দিল। নিশি বলিল, “তবু ভাল।”

দেবী বলিল, “ভাল কি মন্দ, বিবেচনা করিয়া দেখ। যাহা যাহা করিতে হইবে, তোমাকে বলিয়া দিতেছি। তোমার উপর সব নির্ভর।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *