তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বর্ষাকাল। রাত্রি জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না এমন বড় উজ্জ্বল নয়, বড় মধুর, একটু অন্ধকারমাখা–পৃথিবীর স্বপ্নময় আবরণের মত। ত্রিস্রোতা নদী জলপ্লাবনে কূলে কূলে পরিপূর্ণ। চন্দ্রের কিরণে সেই তীব্রগতি নদীজলের স্রোতের উপর–স্রোতে, আবর্তে, কদাচিৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গে জ্বলিতেছে। কোথাও জল একটু ফুটিয়া উঠিতেছে–সেখানে একটু চিকিমিকি; কোথাও চরে ঠেকিয়া ক্ষুদ্র বীচিভঙ্গ হইতেছে, সেখানে একটু ঝিকিমিকি। তীরে, গাছের গোড়ায় জল আসিয়া লাগিয়াছে–গাছের ছায়া পড়িয়া সেখানে জল বড় অন্ধকার; অন্ধকারে গাছের ফুল, ফল, পাতা বাহিয়া তীব্র স্রোত চলিতেছে; তীরে ঠেকিয়া জল একটু তর-তর কল-কল পত-পত শব্দ করিতেছে–কিন্তু সে আঁধারে আঁধারে। আঁধারে, আঁধারে, সে বিশাল জলধারা সমুদ্রানুসন্ধানে পক্ষিণীর বেগে ছুটিয়াছে। কূলে কূলে অসংখ্য কল-কল শব্দ, আবর্তের ঘোর গর্জন, প্রতিহত স্রোতের তেমনি গর্জন; সর্বশুদ্ধ একটা গম্ভীর গগনব্যাপী শব্দ উঠিতেছে।

সেই ত্রিস্রোতার উপরে, কূলের অনতিদূরে একখানি বজরা বাঁধা আছে। বজরার অনতিদূরে একটা বড় তেঁতুলগাছের ছায়ায়, অন্ধকারে আর একখানি নৌকা আছে–তাহার কথা পরে বলিব, আগে বজরার কথা বলি। বজরাখানি নানাবর্ণে চিত্রিত; তাহাতে কত রকম মুরদ আঁকা আছে। তাহার পিতলের হাতল ডাণ্ডা প্রভৃতিতে রূপার গিলটিি। গলুইয়ে একটা হাঙ্গরের মুখ–সেটাও গিলটি করা। সর্বত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, উজ্জ্বল, আবার নিস্তব্ধ। নাবিকেরা এক পাশে বাঁশের উপর পাল ঢাকা দিয়া শুইয়া আছে; কেহ জাগিয়া থাকার চিহ্ন নাই। কেবল বজরার ছাদের উপর–একজন মানুষ। অপূর্ব দৃশ্য!

ছাদের উপর একখানি ছোট গালিচা পাতা। গালিচাখানি দুই আঙ্গুল পুরু–বড় কোমল, নানাবিধ চিত্রে চিত্রিত। গালিচার উপর বসিয়া একজন স্ত্রীলোক। তাহার বয়স অনুমান করা ভার–পঁচিশ বৎসরের নীচে তেমন পূর্ণায়ত দেহ দেখা যায় না; পঁচিশ বৎসরের উপর তেমন যৌবনের লাবণ্য কোথাও পাওয়া যায় না। বয়স যাই হউক–সে স্ত্রীলোক পরম সুন্দরী, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। এ সুন্দরী কৃশাঙ্গী নহে–অথচ স্থূলাঙ্গী বলিলেই ইহার নিন্দা হইবে। বস্তুতঃ ইহার অবয়ব সর্বত্র ষোল কলা সম্পূর্ণ–আজি ত্রিস্রোতা যেমন কূলে কূলে পুরিয়াছে, ইহারও শরীর তেমনই কূলে কূলে পুরিয়াছে। তার উপর বিলক্ষণ উন্নত দেহ। দেহ তেমন উন্নত বলিয়াই স্থূলাঙ্গী বলিতে পারিলাম না। যৌবন-বর্ষার চারি পোয়া বন্যার জল, সে কমনীয় আধারে ধরিয়াছে–ছাপায় নাই। কিন্তু জল কূলে কূলে পুরিয়া টল-টল করিতেছে–অস্থির হইয়াছে। জল অস্থির, কিন্তু নদী অস্থির নহে; নিস্তরঙ্গ। লাবণ্য চঞ্চল, কিন্তু সে লাবণ্যময়ী চঞ্চলা নহে–নির্বিকার। সে শান্ত, গম্ভীর, মধুর অথচ আনন্দময়ী; সেই জ্যোৎস্নাময়ী নদীর অনুষঙ্গিনী। সেই নদীর মত, সেই সুন্দরীও বড় সুসজ্জিতা। এখন ঢাকাই কাপড়ের তত মর্যাদা নাই–কিন্তু এক শত বৎসর আগে কাপড়ও ভাল হইত, উপযুক্ত মর্যাদাও ছিল। ইহার পরিধানে একখানি পরিষ্কার মিহি ঢাকাই, তাতে জরির ফুল। তাহার ভিতর হীরা-মুক্তা-খচিত কাঁচলি ঝক্মনক করিতেছে। নদীর জলে যেমন চিকিমিকি–এই শরীরেও তাই। জ্যোৎস্নাপুলকিত স্থির নদীজলের মত–সেই শুভ্র বসন; আর জলে মাঝে মাঝে যেমন জ্যোৎস্নার চিকিমিকি চিকিমিকি–শুভ্র বসনের মাঝে মাঝে যেমন হীরা, মুক্তা, মতির চিকিমিকি। আবার নদীর যেমন তীরবর্তী বনচ্ছায়া, ইহারও তেমনি অন্ধকার কেশরাশি আলুলায়িত হইয়া অঙ্গের উপর পড়িয়াছে। কোঁকড়াইয়া, ঘুরিয়া ঘুরিয়া, ফিরিয়া ফিরিয়া গোছায় গোছায় খেলা করিতেছে; তাহার সুগন্ধি-চূর্ণ-গন্ধে গগন পরিপূরিত হইয়াছে। এক ছড়া যূঁই ফুলের গড়ে সেই কেশরাজি সংবেষ্টন করিতেছে।
ছাদের উপর গালিচা পাতিয়া, সেই বহুরত্নমণ্ডিতা রূপবতী মূর্তিমতী সরস্বতীর ন্যায় বীণাবাদনে নিযুক্তা। চন্দ্রের আলোয় জ্যোৎস্নার মত বর্ণ মিশিয়াছে; তাহার সঙ্গে সেই মৃদুমধুর বীণার ধ্বনিও মিশিতেছে– যেমন জলে জলে চন্দ্রের কিরণ খেলিতেছে যেমন এ সুন্দরীর অলঙ্কারে চাঁদের আলো খেলিতেছে, এ বন্যকুসুম-সুগন্ধি কৌমুদীস্নাত বায়ুস্তরসকলে সেই বীণার শব্দ তেমনি খেলিতেছিল। ঝম্ ঝম্ ছন্ ছন্ ঝনন্ ঝনন্ ছনন্ ছনন্ দম্ দম্ দ্রিম্ দ্রিম্ বলিয়া বীণে কত কি বাজিতেছিল, তাহা আমি বলিতে পারি না। বীণা কখন কাঁদে, কখন রাগিয়া উঠে, কখন নাচে, কখন আদর করে, কখন গর্জ্জিয়া উঠে,-বাজিয়ে টিপি টিপি হাসে। ঝিঁঝিট, খাম্বাজ, সিন্ধু–কত মিঠে রাগীণী বাজিল– কেদার, হাম্বীর, বেহাগ– কত গম্ভীর রাগিণী বাজিল– কানাড়া, সাহানা বাগীশ্বরী–কত জাঁকাল রাগিণী বাজিল–নাদ, কুসুমের মালার মত নদীকল্লোল-স্রোতে ভাসিয়া গেল। তার পর দুই একটা পরদা উঠাইয়া নামাইয়া লইয়া, সহসা নূতন উৎসাহে উন্মুখী হইয়া সে বিদ্যাবতী ঝন্-ঝন্ করিয়া বীণের তারে বড় বড় ঘা দিল। কাণের পিপুলপাত দুলিয়া উঠিল–মাথায় সাপের মত চুলের গোছা সব নড়িয়া উঠিল–বীণে নটরাগিণী বাজিতে লাগিল। তখন যাহারা পাল মুড়ি দিয়া এক প্রান্তে নিঃশব্দে নিদ্রিতবৎ শুইয়াছিল, তাহার মধ্যে একজন উঠিয়া আসিয়া নিঃশব্দে সুন্দরীর নিকট দাঁড়াইল।

এ ব্যক্তি পুরুষ। সে দীর্ঘদায় ও বলিষ্ঠগঠন; ভারি রকমের এক জোড়া চৌগোঁপ্পা আছে। গলায় যজ্ঞোপবীত। সে নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে?”

সেই স্ত্রীলোক বলিল, “দেখিতে পাইতেছ না?”

পুরুষ বলিল, “কিছু না। আসিতেছে কি?”

গালিচার উপর একটা ছোট দূরবীন পড়িয়াছিল। দূরবীন তখন ভারবর্ষে নূতন আমদানি হইতেছিল। দূরবীন লইয়া সুন্দরী ঐ ব্যক্তির হাতে দিল–কিছু বলিল না। সে দূরবীন চক্ষে দিয়া নদীর সকল দিক নিরীক্ষণ করিল। শেষে এক স্থানে আর একখানি বজরা দেখিতে পাইয়া বলিল, “দেখিয়াছি–টেঁকের মাথায়–ঐ কি?”

উ। এ নদীতে আজকাল আর কোন বজরা আসিবার কথা নাই।

পুরুষ পুনর্বার দূরবীন দিয়া নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।

যুবতী বীণা বাজাইতে বাজাইতে বলিল, “রঙ্গরাজ!”

রঙ্গরাজ উত্তর করিল, “আজ্ঞা?”

“দেখ কি?”

“কয় জন লোক আছে, তাই দেখি।”

“কয় জন?”

“ঠিক ঠাওর পাই না। বেশী নয়। খুলিব?”

“খোল–ছিপ। আঁধারে আঁধারে নিঃশব্দে উজাইয়া যাও।” তখন রঙ্গরাজ ডাকিয়া বলিল, “ছিপ খোল।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *