নবম পরিচ্ছেদ

রামচাঁদ ও শ্যামচাঁদ দুই জন নিরীহ গৃহস্থ লোক মহম্মদপুরে বাস করে। রামচাঁদের চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া, প্রদোষকালে, নিভৃতে তামাকুর সাহায্যে দুই জন কথোপকথন করিতেছিল। কিয়দংশ পাঠককে শুনিতে হইবে।
রা। ভাল ভায়া, বলিতে পার চিত্তবিশ্রামের আসল ব্যাপারটা কি?
শ্যা। কি জান, দাদা, ও সব রাজা–রাজড়ার হয়েই থাকে। আমাদের গৃহস্থ ঘরে কারই বা ছাড়া-তার আর রাজা-রাজড়ার কথায় কাজ কি? তবে আমাদের মহারাজকে ভাল বলতে হবে–মাত্রায় বড় কম। মোটে এই এ একটি।
রা। হাঁ, তা ত বটেই। তবে কি জান, আমাদের মহারাজা না কি সে রকম নয়, পরম ধার্মিক, তাই কথাটা জিজ্ঞাসা করি। বলি, এত কাল ত এ সব ছিল না।
শ্যা। রাজাও আর সে রকম নাই, লোকে ত বলে। কি জান, মানুষ চিরকাল এক রকম থাকে না। ঐশ্বর্য সম্পদ বাড়িলে, মনটাও কিছু এদিক ওদিক হয়! আগে আমরা রামরাজ্যে বাস করিতাম-ভূষণা দখল হ’য়ে অবধি কি আর তাই আছে?
রা। তা বটে। তা আমার যেন বোধ হয় যে, চিত্তবিশ্রামের কাণ্ডটা হ’য়ে অবধিই যেন বাড়াবাড়ি ঘটেছে। তা মহারাজকে এমন বশ করাও সহজ ব্যাপার নয়। মাগীও ত সামান্য নয়-কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসিল?
শ্যা। শুনেছি, সেটা না কি একটা ভৈরবী। কেউ কেউ বলে, সেটা ডাকিনী। ডাকিনীরা নানা মায়া জানে, মায়াতে ভৈরবী বেশ ধ’রে বেড়ায়। আবার কেউ বলে, তার একটা জোড়া আছে, সেটা উড়ে উড়ে বেড়ায়, তাকে বড় কেউ দেখিতে পায় না।
রাম। তবে ত বড় সর্বনাশ! রাজ্য পড়িল ডাকিনীর হাতে। এ রাজ্যের কি আর মঙ্গল আছে?
শ্যাম। গতিকে ত বোধ হয় না। রাজা ত আর রাজ-কর্ম দেখেন না। যা করেন তর্কালঙ্কার ঠাকুর। তা তিনি লড়াই ঝগড়ার কি জানেন? এ দিকে না কি নবাবি ফৌজ শীঘ্র আসিবে।
রাম। আসে, মৃণ্ময় আছে।
শ্যা। তুমিও যেমন দাদা! পরের কি কাজ! যার কর্ম তার সাজে, অন্য লোকের লাঠি বাজে। এই ত দেখ‍‍লে, গঙ্গারাম দাস কি করলে!? আবার কে জানে, মৃণ্ময় বা কি করবে? সে যদি মুসমলানের সঙ্গে মিশে যায়, তবে আমরা দাঁড়াই কোথা? গোষ্ঠী শুদ্ধ জবাই হব দেখতে পাচ্চি।
রা। তা বটে। তাই একে একে সব সরিতে আরম্ভ করেছে বটে! সে দিন তিলক ঘোষেরা উঠে যশোর গেল, তখন বুঝিতে পারিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম যে, কেন যাও? বলে, এখানে জিনিসপত্র মাগ্যি। এখনই ত আরও কয় ঘর আমাদের পাড়া হইতে উঠিয়া গিয়াছে।
শ্যাম। তা দাদা, তোমার কাছে বল‍‍চি, প্রকাশ করিও না, আমিও শিগ‍‍গির সরবো।
রা। বটে! তা আমিই পড়ে জবাই হই কেন? তবে কি জান, এই সব বাড়ী-ঘর-দ্বার খরচপত্র করে করা গেছে, এখন ফেলে ঝেলে যাওয়া গরিব মানুষর বড় দায়।
শ্যা। তা কি করবে, প্রাণটা আগে, না বাড়ী–ঘর আগে? ভাল, রাজ্য বজায় থাকে, আবার আসা যাবে। ঘর–দ্বার ত পালাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *