প্রথম পরিচ্ছেদ

সীতারাম প্রথমাবধিই শ্রীর বহুবিধ অনুসন্ধান করিয়াছিলেন। মাসের পর মাস গেল, বৎসরের পর বৎসর গেল। এই কয় বৎসর সীতারাম ক্রমশঃ শ্রীর অনুসন্ধান করিতেছিলেন। তীর্থে তীর্থে নগরে নগরে তাহার সন্ধানে লোক পাঠাইয়াছিলেন। কিন্তু ফল দর্শে নাই। অন্য লোকে শ্রীকে চিনে না বলিয়া সন্ধান হইতেছে না, এই শঙ্কায় গঙ্গারামকেও কিছু দিনের জন্য রাজকর্ম হইতে অবসৃত করিয়া এই কার্যে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। গঙ্গারামও বহু দেশ পর্যটন করিয়া শেষে নিষ্ফল হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছিল।
শেষে সীতারাম স্থির করিলেন যে, আর শ্রীকে মনে স্থান দিবেন না। রাজ্যস্থাপনেই চিত্তনিবেশ করিবেন। তিনি এ পর্যন্ত প্রকৃত রাজা হয়েন নাই; কেন না, দিল্লীর সম্রাট তাঁহাকে সনন্দ দেন নাই। তাঁর সনন্দ পাইবার অভিলাষ হইল। সেই অভিপ্রায়ে তিনি অচিরে দিল্লী যাত্রা করিবেন, ইহা স্থির করিলেন।
কিন্তু সময়টা বড় মন্দ উপস্থিত হইল। কেন না, হিন্দুর হিন্দুয়ানি বড় মাথা তুলিয়া উঠিতেছিল, মুসলমানের তাহা অসহ্য হইয়া উঠিল। নিজ মহম্মদপুর উচ্চচূড় দেবালয় সকলে পরিপূর্ণ হইয়াছিল। নিকটে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে গৃহে গৃহে দেবালয় প্রতিষ্ঠা, দৈবোৎসব, নৃত্য-গীত, হরিসংকীর্ত্তনে দেশ চঞ্চল হইয়া উঠিল। আবার এ সময়ে, মহাপাপিষ্ঠ, মনুষ্যাধম মুরশিদকুলি খাঁ12 মুরশিদাবাদের মসনদে আরূঢ় থাকায়, সুবে বাঙ্গালার আর সকল প্রদেশে হিন্দুর উপর অতিশয় অত্যাচার হইতে লাগিল-বোধ হয়, ইতিহাসে তেমন অত্যাচার আর কোথাও লিখে না। মুরশিদ কুলি খাঁ শুনিলেন, সর্বত্র হিন্দু ধূল্যবলুণ্ঠিত, কেবল এইখানে তাহাদের বড় প্রশ্রয়। তখন তিনি তোরাব খাঁর প্রতি আদেশ পাঠাইলেন-“সীতারামকে বিনাশ কর |”
অতএব ভূষণায় সীতারামের ধ্বংসের উদ্যোগ হইতে লাগিল। তবে, ‘উদ্যোগ কর’ বলিবামাত্র উদ্যোগ হইয়া উঠিল না, কেন না, মুরশিদ কুলি খাঁ সীতারামের বধের জন্য হুকুম পাঠাইয়াছিলেন, ফৌজ পাঠান নাই। ইহাতে তিনি তোরাবের প্রতি কোন অবিচার করেন নাই, মুসলমানের পক্ষে তাঁহার অবিচার ছিল না। তখনকার সাধারণ নিয়ম এই ছিল যে,-সাধারণ ‘শান্তিরক্ষার’কার্যফৌজদারেরা নিজ ব্যয়ে করিবেন,–বিশেষ কারণ ব্যতীত নবাবের সৈন্য ফৌজদারের সাহায্যে আসিত না। এক জন জমিদারকে শাসিত করা, সাধারণ শান্তিরক্ষার কার্যের মধ্য গণ্য-তাই নবাব কোন সিপাহী পাঠাইলেন না। এ দিকে ফৌজদার হিসাব করিয়া দেখিলেন যে, যখন শুনা যাইতেছে যে, সীতারাম রায়, আপনার এলাকার সমস্ত বয়:প্রাপ্ত পুরুষদিগকে অস্ত্রবিদ্যা শিখাইয়াছে, তখন ফৌজদারের যে কয় শত সিপাহী আছে, তাহা লইয়া মহম্মদপুর আক্রমণ করিতে যাওয়া বিধেয় হয় না। অতএব ফৌজদারের প্রথমকার্যসিপাহী-সংখ্যা বৃদ্ধি করা। সেটা দুই এক দিনে হয় না। বিশেষ তিনি পশ্চিমে মুসলমান-দেশী লোকের যুদ্ধ করিবার শক্তির উপর তাঁহার কিছু মাত্র বিশ্বাস ছিল না। অতএব মুরশিদাবাদ বা বেহার বা পশ্চিমাঞ্চল হইতে সুশিক্ষিত পাঠান আনাইতে নিযুক্ত হইলেন। বিশেষত: তিনি শুনিয়াছিলেন যে, সীতারামও অনেক শিক্ষিত রাজপুত ও ভোজপুরী (বেহারবাসী) আপনার সৈন্যমধ্যে নিবিষ্ট করিয়াছেন। কাজেই তদুপযোগী সৈন্য সংগ্রহ না করিয়া সীতারামকে ধ্বংস করিবার জন্য যাত্রা করিতে পারিলেন না। তাহাতে একটু কালবিলম্ব হইল। ততদিন যেমন চলিতেছিল, তেমনই চলিতে লাগিল।
তোরাব খাঁ বড় গোপনে এই সকল উদ্যোগ করিতেছিলেন। সীতারাম অগ্রে যাহাতে কিছুই না জানিতে পারে, হঠাৎ গিয়া তাহার উপর ফৌজ লইয়া পড়েন, ইহাই তাঁহার ইচ্ছা। কিন্তু সীতারাম সমুদয়ই জানিতেন। চতুর চন্দ্রচূড় জানিতেন। গুপ্তচর ভিন্ন রাজ্য নাই-রামচন্দ্রের ও দুর্মুখ ছিল। চন্দ্রচূড়ের গুপ্তচর ভূষণার ভিতরেও ছিল। অতএব সীতারামকে রাজধানী সহিত ধ্বংস করিবার আজ্ঞা যে মুরশিদাবাদ হইতে আসিয়াছে, এবং তজ্জন্য বাছা বাছা সিপাহী সংগ্রহ হইতেছে, ইহা চন্দ্রচূড় জানিলেন।
ইহার সকল উদ্যোগ করিয়া সীতারাম কিছু অর্থ এবং রক্ষকবর্গ সঙ্গে লইয়া দিল্লী যাত্রা করিলেন। গমনকালে সীতারাম রাজ্যরক্ষার ভার চন্দ্রচূড়, মৃণ্ময় ও গঙ্গারামের উপর দিয়া গেলেন। মন্ত্রণা ও কোষাগারের ভার চন্দ্রচূড়ের উপর, সৈন্যের অধিকার মৃণ্ময়কে, নগররক্ষার ভার গঙ্গারামকে, এবং অন্তঃপুরের ভার নন্দাকে দিয়া গেলেন। কাঁদাকাটির ভয়ে সীতারাম রমাকে বলিয়া গেলেন না। সুতরাং রমা কাঁদিয়া দেশ ভাসাইল।

=========================================
12- ইংরেজ ইতিহাসবেতত্তৃগণের পক্ষপাত এবং কতকটা অজ্ঞতা নিবন্ধন সেরাজউদ্দৌলা ঘৃণিত, এবং মুরশি্দ কুলি খাঁ প্রশংসিত। মুরশিতদের তুলনায় সেরাজউদ্দৌলা দেবতাবিশেষ ছিলেন।
=========================================

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *