উত্তরচরিত
হরেস্ হেমান উইলসন্ বলেন যে, উত্তরচরিতে কতকগুলি এমত সুন্দর ভাব আছে যে, তদপেক্ষা সুন্দর ভাব কোন ভাষাতেই নাই। উপরে উদ্ধৃত কবিতা এই কথার উদাহরণস্বরূপ তিনি উল্লেখ করিয়াছেন।
রামচন্দ্র শম্বুকের সন্ধান করিতে করিতে পঞ্চবটীর বনে শাম্বুককে পাইলেন, এবং খড়্গদ্বারা তাহাকে প্রহার করিলেন। শাম্বুক দিব্য পুরুষ; রামের প্রহারে শাপমুক্ত হইয়া রামকে প্রণিপাত করিল। এবং জনস্থানাদি রামচন্দ্রের পূর্ব্বপরিচিত স্থান সকল দেখাইতে লাগিল। উভয়ের কথোপকথনের বনবর্ণনা অতি মনোহর।
স্নিগ্ধশ্যামাঃ ক্কচিদপরতো ভীষণাভোগরুক্ষাঃ
স্থানে স্থানে মুখরককুভো ঝাঙ্কৃতৈর্রনর্ঝরাণাম্।
এতে তীর্থশ্রমগিরিসরিদ্গর্ত্তকান্তরমিশ্রাঃ
সন্দৃশ্যন্তে পরিচিতভুবো দণ্ডকারণ্যভাগাঃ॥
এতানি খলু সর্ব্বভূতলোমহর্ষণানি উন্মত্তচণ্ডশ্বাপদকুলসঙ্কুলগিরিগহ্বরাণি জনস্থান— পর্য্যন্তদীর্ঘারণ্যানি দক্ষিণাং দিশমভিবর্ত্তন্তে।
তথাহি
নিষ্কূজস্তিমিতাঃ ক্কচিৎ ক্কচিদপি প্রোচণ্ডসত্ত্বস্বনাঃ
স্বেচ্ছাসুপ্তগভীরভোগভুজগশ্বাসপ্রদীপ্তাগ্নয়ঃ।
সীমানঃপ্রদরোদরেষু বিলসৎস্ববল্পাম্ভসো যাস্বয়ং
তষ্যাদ্ভিঃ প্রতিসূর্য্যকৈরজগরস্বেদদ্রবঃ পীয়তে॥
****
অথৈতানি মদকলময়ূরকণ্ঠকোমলচ্ছবিভিরবকীর্ণানি পর্য্যন্তৈরবিরলনিবিষ্টন—নীলবহলচ্ছায়তরুণতরুষণ্ডমণ্ডিতানি অসম্ভ্রান্তবিবিধমৃগযূথানি। পশ্যতু মহানুভাবঃ প্রশান্তগম্ভীরাণি মধ্যমারণ্যকানি
ইহ সমদশকুন্তাক্রান্তবানীরবীরুৎ—
প্রসবসুরভিশীতস্বচ্ছতোয়া বহন্তি।
ফলভরপরিণামশ্যামজম্বুনিকুঞ্জ—
স্খলনমুখরভূরিস্রোতসো নির্ঝরিণ্যঃ॥
অপিচ
দধতি কুহরভাজামত্র ভল্লুকযূনা—
মনুরসিতগুরূণি স্ত্যানমম্বূকৃতানি।
শিশিরকটুকষায়ঃ স্ত্যায়তে শল্লকীনা—
মিভদলিতবিকীর্ণগ্রন্থিনিষ্যন্দগন্ধঃ॥[note]এই যে পরিচিতভূমি দণ্ডাকারণ্য ভাগ দেখা যাইতেছে। কোথাও স্নিগ্ধশ্যাম, কোথাও ভয়ঙ্কর রুক্ষদৃশ্য, কোথাও বা নির্ঝরগণের ঝরঝরশব্দে দিক্ সকল শব্দিত হইতেছে; কোথাও পুণ্যতীর্থ, কোথাও মুনিগণের আশ্রমপদ, কোথাও পর্ব্বত, কোথাও নদী এবং মধ্যে মধ্যে অরণ্য।
ঐ যে জনস্থান পর্য্যন্ত দীর্ঘ অরণ্য সকল দক্ষিণদিকে চলিতেছে। এ সকল সর্ব্বলোকলোমহর্ষণ—অস্ত্র গিরিগহ্বর উন্মত্ত প্রচণ্ড হিংস্র পশুগণে সমাকুল। কোথাও বা একেবারে নিঃশব্দ; কোথাও পশুদিগের প্রচণ্ড গর্জ্জনপরিপূর্ণ; কোথাও বা স্বেচ্ছাসুপ্ত গভীর গর্জ্জনকারী ভুজঙ্গের নিঃশ্বাসে অগ্নি প্রজ্বলিত। কোথাও গর্ত্তে অল্প জল দেখা যাইতেছে। কৃষিত কৃকলাসেরা অজগরের ঘর্ম্মবিন্দু পান করিতেছে।
**** দেখুন, এই মধ্যমারণ্য সকল কেমন প্রশান্ত গম্ভীর! মদকল ময়ূরের কন্ঠের ন্যায় কোমলচ্ছবি পর্ব্বতে অবকীর্ণ; ঘননিবিষ্ট, নীলপ্রধান কান্তি, অনতিপ্রৌঢ় বৃক্ষসমূহে শোভিত; এবং ভয়শূন্য বিবিধ মৃগযূথে পরিপূর্ণ। স্বচ্ছতোয়া নির্ঝরিণীসকল বহুস্রোতে বহিতেছে, আনন্দিত পক্ষী সকল তত্রস্থ বেতসলতার উপর বসিতেছে, তাহাতে বেতসের কুসুম বৃন্তচ্যুত হইয়া সেই জলে পড়িয়া জলকে সুগন্ধি এবং সুশীতল করিতেছে; স্রোতঃ পরিপক্কফলময় শ্যামজম্বুবনান্তে স্খলিত হওয়াতে শব্দিত হইতেছে। গিরিবিবরবাসী যুবা ভল্লুকদিগের থুৎকারশব্দ প্রতিধ্বনিতে গম্ভীর হইতেছে। এবং গজগণের দ্বারা ভগ্ন শল্লকী বৃক্ষের নিক্ষিপ্ত গ্রন্থি হইতে শীতল কটু কষায় সুগন্ধ বাহির হইতেছে।[/note]
প্রবন্ধের অসহ্য দৈর্ঘ্যাশঙ্কায় আর অধিক উদ্ধৃত করিতে পারিলাম না।
শম্বুক বিদায়ের পর পুনরাগমনপূর্ব্বক রামকে জানাইলেন যে, অগস্ত্য রামাগমন শুনিয়া তাঁহাকে আশ্রমে আমন্ত্রিত করিতেছেন। শুনিয়া রাম তথায় চলিলেন। গমনকালীন ক্রৌঞ্চাবত পর্ব্বতাদির বর্ণনা অতি মনোহর। আমরা সচরাচর অনুপ্রাসালঙ্কারের প্রশংসা করি না, কিন্তু এরূপ অনুপ্রাসের উপর বিরক্ত হওয়াও যায় না।
গুঞ্জৎকুঞ্জকুটীরকৌশিকঘটাঘুৎকারবৎকীচক—
স্তম্বাড়ম্বরমূকমৌকুলিকুলঃ ক্রৌঞ্চাবতোহয়ং গিরিঃ।
এতস্মিন্ প্রচলাকিনাং প্রচলতামুদ্বেজিতাঃ কূজিতৈ—
রুদ্বেল্লন্তি পুরাণরোহিণতরুস্কন্ধেষু কুম্ভীনসাঃ॥
এতে তে কুহরেষু গদ্গদনদদ্গোদাবরীবারয়ো
মেঘালঙ্কৃতমৌলিনীলশিখরাঃ ক্ষৌণীভৃতো দক্ষিণাঃ।
অন্যোন্যোপ্রতিঘাতসঙ্কুলচলৎ কল্লোলকোলাহলৈ—
রুত্তালাস্ত ইমে গভীরপয়সঃ পুণ্যাঃ সরিৎসঙ্গমাঃ॥[note]এই পর্ব্বত ক্রৌঞ্চাবত। এখানে অব্যক্তনাদী কুঞ্জকুটীরবাসী পেচককুলের ঘুৎকারশব্দিত বায়ুযোগধ্বনিত বংশবিশেষের গুচ্ছে ভীত হইয়া কাকেরা নিঃশব্দে আছে। এবং ইহাতে সর্পেরা, চঞ্চল ময়ূরগণের কেকারবে ভীত হইয়া পুরাতন বটবৃক্ষের স্কন্ধে লুকাইয়া আছে। আর এই সকল দক্ষিণ পর্ব্বত। পর্ব্বতকুহরে গোদাবরীবারিরাশি গদ্গদনিনাদ করিতেছে; শিরোদেশ মেঘমালায় অলঙ্কৃত হইয়া নীল শোভা ধারণ করিয়াছে; আর এই গভীরজলশালিনী পবিত্রা নদীগণের সঙ্গম পরস্পরের প্রতিঘাতসঙ্কুল চঞ্চল তরঙ্গকোলাহলে দুর্দ্ধর্ষ হইয়া রহিয়াছে।[/note]
তৃতীয়াঙ্ক অতি মনোহর। সত্য বটে যে, এই উৎকৃষ্ট নাটকে ক্রিয়াপারম্পর্য্য বড় মনোহর নহে, এবং তৃতীয়াঙ্ক সেই দোষে বিশেষ দৃষ্ট। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম অঙ্ক যেরূপ বিস্তৃত, তদনুরূপ বহুল ক্রিয়াপরম্পরা নায়ক নায়িকাগণ কর্ত্তৃক সম্পন্ন হয় নাই। যিনি মাক্বেথ পাঠ করিয়াছেন, তিনি জানেন যে, নাটকে বর্ণিতা ক্রিয়া সকলের বাহুল্য, পারম্পর্য্য এবং শীঘ্র সম্পাদন, কি প্রকার চিত্তকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। কার্য্যগত এই গুণ নাটকের একটি প্রধান গুণ। উত্তরচরিতে তাহার
বিরলপ্রচার; বিশেষতঃ প্রথম ও তৃতীয়াঙ্কে। তথাপি ইহাতে কবি যে অপূর্ব্ব কবিত্ব প্রকাশ করিয়াছেন, সেই গুণে আমরা সে সকল দোষ বিস্মৃত হই।
দ্বিতীয়াঙ্কের বিষ্কম্ভক যেমন মধুর, তৃতীয়াঙ্কের বিষ্কম্ভক ততোধিক। গোদাবরী সংমিলিতা, তমসা, ও মুরলা নাম্নী দুইটি নদী রূপ ধারণ করিয়া রামসীতাবিষয়িণী কথা কহিতেছে।
অদ্য দ্বাদশ বৎসর হইল, রামচন্দ্র সীতাকে বিসর্জ্জন করিয়াছেন। প্রথম বিরহে তাঁহার যে গুরুতর শোক উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা পূর্ব্বে বর্ণিত হইয়াছে। কালসহকারে সে শোকের লাঘব জন্মিবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তাহা ঘটে নাই; সর্ব্বসন্তাপহর্ত্তা কাল এই সন্তাপের শমতা সাধিতে পারে নাই।
অনির্ভিন্নো গভীরত্বাদন্তর্গূঢ়ঘনব্যথঃ।
পুটপাকপ্রতীকাশো রামস্য করুণো রসঃ॥[note]অবিলচিত গভীরত্বহেতুক হৃদয়মধ্যে রুদ্ধ, এ জন্য গাঢ়ব্যথ রামের সন্তাপ মুখবদ্ধ পাত্রমধ্যে পাকের সন্তাপের ন্যায় বাহিরে প্রকাশ পায় না।[/note]
এইরূপ মর্ম্মমধ্যে রুদ্ধ সন্তাপে দগ্ধ হইয়া রাম, পরিক্ষীণ শরীরে রাজকর্ম্মানুষ্ঠান করিতেন। রাজকর্ম্মে ব্যাপৃত থাকিলে, সে কষ্টের তাদৃশ বাহ্য প্রকাশ পায় না; কিন্তু আজ পঞ্চবটীতে আসিয়া রামের ধৈর্য্যাবলম্বনের সে উপায়ও নাই। এ আবার সেই জনস্থান; পদে পদে সীতাসহবাসের চিহ্নপরিপূর্ণ। এই জনস্থানে কত কাল, কত সুখে, সীতার সহিত বাস করিয়াছিলেন, তাহা পদে পদে মনে পড়িতেছে। রামের সেই দ্বাদশ বৎসরের রুদ্ধ শোকপ্রবাহ ছুটিয়াছে—সে প্রবাহবলে, এই গোদাবরীস্রোতঃস্খলিত শিলাচয়ের ন্যায় রামের হৃদয়পাষাণ আজি কোথায় যাইবে, কে বলিতে পারে?
জনস্থানবাহিনী করুণাদ্রাবিতা নদীগুলিন্ দেখিল যে, আজি বড় বিপদ্। তখন মুরলা কলকল করিয়া গোদাবরীকে বলিতে চলিল, “ভগবতি! সাবধান থাকিও—আজ রামের বড় বিপদ্। দেখিও, রাম যদি মূর্চ্ছা যান, তবে তোমার জলকণাপূর্ণ শীতল তরঙ্গের বাতাসে মৃদু মৃদু তাঁহার মূর্চ্ছা ভঙ্গ করিও।” রঘুকুলদেবতা ভাগীরথী এই শোকতপনাতপসন্তাপ হইতে রামকে রক্ষা করিবার জন্য এক সর্ব্বসন্তাপসংহারিণী ছায়াকে জনস্থানে পাঠাইলেন। সেই ছায়ার স্নিগ্ধতায় অদ্যাপি ভারতবর্ষ মুগ্ধ রহিয়াছে। সেই ছায়া হইতে কবি এই তৃতীয়াঙ্কের নাম রাখিয়াছিলেন “ছায়া।”—এই ছায়া, বহুকালবিস্মৃতা, পাতালপ্রবিষ্টা, শীর্ণদেহমাত্র—বিশিষ্টা হতভাগিনী রামমোহিনী সীতার ছায়া।
সীতা লবকুশকে প্রসব করিলে পর, ভাগিরথী এবং পৃথিবী বালক দুইটিকে বাল্মীকির আশ্রমে রাখিয়া সীতাকে পাতালে লইয়া গিয়া রাখিয়াছিলেন। অদ্য কুশলবের জন্মতিথি—সীতাকে স্বহস্তাবচিত কুসুমাঞ্জলি দিয়া পতিকুলাদিপুরুষ সূর্য্যদেবের পূজা করিতে ভাগীরথী এই জনস্থানে পাঠাইলেন। এবং আপন দৈবশক্তিপ্রভাবে রঘুকুলবধূকে অদর্শনীয়া করিলেন। ছায়ারূপিণী সীতা সকলকে দেখিতে পাইতেছিলেন। সীতাকে কেহ দেখিতে পাইতেছিল না।
সীতা তখন জানেন না যে, রাম জনস্থানে আসিয়াছেন। সীতাও আসিয়া জনস্থানে প্রবেশ করিলেন। তখন তাঁহার আকৃতি কিরূপ? তাঁহার মুখ “পরিপাণ্ডুদুর্ব্বল কপোলসুন্দর”—কবরী বিলোল—শারদাতপসন্তপ্ত কেতকীকুসুমা—ন্তর্গত পত্রের ন্যায়, বন্ধনবিচ্যুত কিসলয়ের মত সীতা সেই অরণ্যে প্রবেশ করিলেন। জনস্থানে তাঁহার গভীর প্রেম! পূর্ব্বসুখের স্থান দেখিয়া বিস্মৃতি জন্মিল—আবার সেই দিন মনে পড়িল। যখন সীতা রামসহবাসে এই বনে থাকিতেন, তখন জনস্থানবনদেবতা বাসন্তীর সহিত তাঁহার সখিত্ব হইয়াছিল। তখন সীতা একটি করিশাবককে স্বহস্তে শল্লকীর পল্লবাগ্রভাগ ভোজন করাইয়া পুত্রের ন্যায় প্রতিপালন করিয়াছিলেন। এখন সেই করিশাবকও ছিল। এইমাত্র সে বধূসঙ্গে জলপানে গিয়াছে। এক মত্ত যূথপতি আসিয়া অকস্মাৎ তৎপ্রতি আক্রমণ করিল। সীতা তাহা দেখেন নাই। কিন্তু অন্যত্রস্থিতা বাসন্তী দেখিতে পাইয়াছিলেন। বাসন্তী তখন উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিলেন, “সর্ব্বনাশ হইল, সীতার পালিত করিকরভকে মারিয়া ফেলিল!” রব সীতার কর্ণে গেল। সেই জনস্থান, সেই পঞ্চবটী! সেই বাসন্তী! সেই করিকরভ! সীতার ভ্রান্তি জন্মিল। পুত্রীকৃত হস্তিশাবকের বিপদে বিহ্বলচিত্ত হইয়া ডাকিলেন, “আর্য্যপুত্র! আমার পুত্রকে বাঁচাও!” কি ভ্রম! আর্য্যপুত্র? কোথায় আর্য্যপুত্র? আজি বার বৎসর সে নাম নাই! অমনি সীতা মূর্চ্ছিতা হইয়া পড়িলেন। তমসা তাঁহাকে আশ্বস্তা করিতে লাগিলেন। এ দিকে রামচন্দ্র লোপামুদ্রার আহ্বানানুসারে অগস্ত্যাশ্রমে যাইতেছিলেন। পঞ্চবটী বিচরণ করিবার মানসে সেইখানে বিমান রাখিতে বলিলেন। রামের কণ্ঠস্বর মূর্চ্ছিতা সীতার কাণে গেল। অমনি সীতার মূর্চ্ছাভঙ্গ হইল—সীতা ভয়ে, আহ্লাদে, উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন, “একি এ? জলভরা মেঘের স্তনিতগম্ভীর মহাশব্দের মত কে কথা কহিল? আমার কর্ণবিবর যে ভরিয়া জলে ভরিয়া গেল। আজি কে আমা হেন মন্দভাগিনীকে সহসা আহ্লাদিত করিল?” দেখিয়া তমসার চক্ষু জলে ভরিয়া গেল। তমসা বলিলেন, “কেন বাছা, একটি অপরিস্ফুট শব্দ শুনিয়া মেঘের ডাকে ময়ূরীর মত চমকিয়া উঠিলি?” সীতা বলিলেন, “কি বলিলে ভগবতি? অপরিস্ফুট? আমি সে স্বরেই চিনেছি, আমার সেই আর্য্যপুত্র কথা কহিতেছেন।” তমসা তখন দেখিলেন, আর লুকান বৃথা—বলিলেন, “শুনিয়াছি, মহারাজ রামচন্দ্র কোন শূদ্র তাপসের দণ্ড জন্য এই জনস্থানে আসিয়াছেন।” শুনিয়া সীতা কি বলিলেন? বার বৎসরের পর স্বামী নিকটে, নয়নের পুত্তলীর অধিক প্রিয়, হৃদয়ের শোণিতের অধিক প্রিয়, সেই স্বামী আজি বার বৎসরের পর নিকটে, শুনিয়া সীতা কি বলিলেন? শুনিয়া সীতা কিছুই আহ্লাদে প্রকাশ করিলেন না—“কই স্বামী—কোথায় সে প্রাণাধিক?” বলিয়া দেখিবার জন্য তমসাকে উৎপীড়িতা করিলেন না, কেবল বলিলেন—
“দিঠ্ঠিআ অপরিহীনরাঅধম্মো ক্খু সো রাআ”—সৌভাগ্যক্রমে সে রাজার রাজধর্ম্ম পালনে ত্রুটি হইতেছে না।”
যে কোন ভাষায় যে কোন নাটকে যাহা কিছু আছে, এতদংশ সৌন্দর্য্যে তাহার তুল্য, সন্দেহ নাই। “দিঠ্ঠিআ অপরিহীনরাঅধম্মো ক্খু সো রাআ।” এইরূপ বাক্য কেবল সেক্ষপীয়রেই পাওয়া যায়। রাম আসিয়াছেন শুনিয়া সীতা আহ্লাদের কথা কিছুই বলিলেন না, কেবল বললেন, “সৌভাগ্যক্রমে সে রাজার রাজধর্ম্মপালনে ত্রুটি হইতেছে না।” কিন্তু দূর হইতে রামের সেই বিরহক্লিষ্ট প্রভাতচন্দ্রমণ্ডলবৎ আকার দেখিয়া “সখি, আমায় ধর” বলিয়া তমসাকে ধরিয়া বসিয়া পড়িলেন। এ দিকে রাম পঞ্চবটী দেখিতে দেখিতে, সীতাবিরহপ্রদীপ্তনলে পুড়িতে পুড়িতে, “সীতে! সীতে!” বলিয়া ডাকিতে ডাকিতে মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন। দেখিয়া সীতাও উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিয়া তমসার পদপ্রান্তে পতিত হইয়া ডাকিলেন, “ভগবতি তমসে! রক্ষা কর! রক্ষা কর! আমার স্বামীকে বাঁচাও!”
তমসা বলিলেন, “তুমিই বাঁচাও। তোমার স্পর্শে উনি বাঁচিতে পারেন!” শুনিয়া সীতা বলিলেন, “যা হউক তা হউক, আমি তাহাই করিব!” এই বলিয়া সীতা রামকে স্পর্শ করিলেন।[note]“যা হউক তা হউক।” এই কথার কত অর্থগাম্ভীর্য্য! বিদ্যাসাগর মহাশয় এই বাক্যের টীকায় লিখিয়াছেন যে, “আমার পাণিস্পর্শে আর্য্যপুত্র বাঁচিবেন কি না, জানি না, কিন্তু ভগবতী বলিতেছেন বলিয়া আমি স্পর্শ করিব।” ইহাতে এই বুঝিতে হইতেছে যে, পাণিস্পর্শ সফল হইবে কি না, এই সন্দেহেই সীতা বলিলেন,“যা হউক তা হউক!” কিন্তু আমাদিগের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বোধ যে সন্দেহে সীতা বলেন নাই যে, “যা হবার হউক!” সীতা ভাবিয়াছিলেন, “রামকে স্পর্শ করিবার আমার কি অধিকার? রাম আমাকে ত্যাগ করিয়াছেন, তিনি আমাকে বিনাপরাধে বিসর্জ্জন করিয়াছেন,— বিসর্জ্জন করিবার সময়ে একবার আমাকে ডাকিয়াও বলেন নাই যে, আমি তোমাকে ত্যাগ করিলাম—আজি বার বৎসর আমাকে ত্যাগ করিয়া সম্বন্ধ রহিত করিয়াছেন, আজি আবার তাঁহার প্রিয়পত্নীর মত তাঁহার গাত্রস্পর্শ করিব কোন্ সাহসে? কিন্তু তিনি ত মৃতপ্রায়! যা হউক তা হউক, আমি তাঁহাকে স্পর্শ করিব।” তাই ভাবিয়া সীতাস্পর্শে রাম চেতনাপ্রাপ্ত হইলে, সীতা বলিলেন, “ভঅবদি তমসে! ওসরহ্ম, জই দাব মৎ পেক্খিস্মদি তদো তণব্ভণুণ্ণাদসণ্ণিধাণেণ অহিঅদরং মম মহারাও কুবিস্মদি।” তবু “মম মহারাও!”[/note] রাম চেতনা প্রাপ্ত হইলেন।
পরে সীতার পূর্ব্বকালের প্রিয়সখী, বনদেবতা বাসন্তী সীতার পুত্রীকৃত করিশাবকের সহায়ান্বেষণ করিতে করিতে সেইখানে উপস্থিতা হইলেন। রামের সঙ্গে তাঁহার সাক্ষাৎ হওয়ায়, রাম করিশিশুর রক্ষার্থ গেলেন। সে হস্তিশিশু স্বয়ং শত্রুজয় করিয়া করিণীর সহিত ক্রীড়া করিতে লাগিল। তদ্বর্ণনা অতি মধুর।
যেনোদ্গচ্ছদ্বিসকিশলয়স্নিগ্ধদন্তাঙ্কুরেণ
ব্যাকৃষ্টস্তে সুতনু লবলীপল্লবঃ কর্ণপূরাৎ।
সোহয়ং পুত্রস্তব মদমুচাং বারণনাং বিজেতা
যৎকল্যাণং বয়সি তরুণ্যে ভাজনং তস্য জাতঃ॥
সখি বাসন্তি, পশ্য পশ্য, কান্তানুবৃত্তিচাতুর্য্যমপি অনুশিক্ষিতং বৎসেন।
লীলোৎখাতমৃণালকাণ্ডকবলচ্ছেদেষু সম্পাতিতাঃ
পুষ্পৎপুষ্করবাসিতস্য পয়সো গণ্ডূষসংক্রান্তয়ঃ।
সেকঃ শীকরিণা করেণ বিহিতঃ কামং বিরামে পুন—
র্যৎস্নেহাদনরালনালনলিনীপত্রাতপত্রং ধৃতম্॥[note]যে নবোদ্গত মৃণালপল্লবের ন্যায় কোমল দন্ত দ্বারা তোমার কর্ণদেশ হইতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লবলীপল্লব টানিয়া লইত, সেই তোমার পুত্র মদমত্ত বারণগণকে জয় করিল, সুতরাং এখনই সে যুবাবয়সের কল্যাণভাজন হইয়াছে। * * সতি বাসন্তি, দেখ, বাছা কেমন নিজ কান্তার মনোরঞ্জননৈপুণ্যও শিখিয়াছে। খেলা করিতে করিতে মৃণালকাণ্ড উৎপাটিত করিয়া তাহার গ্রাসের অংশে সুগন্ধি পদ্মসুবাসিত জলের গণ্ডূষ মিশাইয়া দিতেছে; এবং শুণ্ডের দ্বারা পর্য্যাপ্ত জলকণায় তাহাকে সিদ্ধ করিয়া, স্নেহে অবক্রদণ্ড নলিনীপত্রের আতপত্র ধরিতেছে।[/note]
এদিকে পত্রীকৃত করী দেখিয়া সীতার গর্ভজ পুত্রদিগকে মনে পড়িল। কেবল স্বামিদর্শনে বঞ্চিতা নহেন,—পুত্রমুখ দর্শনেও বঞ্চিতা। সেই মাতৃমুখনির্গত পুত্রমুখ—স্মৃতিবাক্য উদ্ধৃত করিতেছি।
মম পুত্তকাণং ইসিবিরলকোমলধঅলদসণুজ্জলকবোলং অণুবদ্ধমুদ্ধকাঅলি—বিহসিদং ণিবদ্ধকাকসিহণ্ডঅং অমলমুহপুণ্ডরীঅজুঅলং ণ পরিচুম্বিদং উজ্জউ—ত্তেণ।[note] আমার সেই পুত্র দুটির অমলমুখপদ্মযুগল, যাহাতে কপোলদেশ ঈষদ্বিরল এবং কোমল ধবল দশনে উজ্জ্বল, যাহাতে মৃদুমধুর হাসির অব্যক্তধ্বনি অবিরল লাগিয়া রহিয়াছে, যাহাতে কাকপক্ষ নিবদ্ধ আছে, তাহা আর্য্যপুত্র কর্ত্তৃক পরিচুম্বিত হইল না![/note]
আমরা শুধু বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের কথাই জানি, তিনি যে অনেক ভাল প্রবন্ধ ও গ্রন্থ সমালোচনাও লিখেছেন, এই সাইটে না এলে জানতে পেতাম না।