January 30, 2016January 30, 2016 0 Comments
বৃত্রসংহার
এই মহাকাব্যের বিষয়, ইন্দ্রকৃত বৃত্রের বধ। হেমবাবু পৌরাণিক বৃত্তান্তের অবিকল অনুসরণ করেন নাই—অনেক স্থানেই নিজ কল্পনাকে স্ফুরিত করিয়াছেন। পাতালে, বৃত্রজিত, নির্বাসিত দেবগণ মন্ত্রণায় নিযুক্ত। এই স্থানে গ্রন্থারম্ভ। প্রথম সর্গ পড়িয়া অনেকেরই পাণ্ডিমোনিয়ামে মন্ত্রণানিযুক্ত দেবদূতগণের কথা মনে পড়িবে। হেমবাবু স্বয়ং স্বীকার করিয়াছেন যে, “বাল্যাবধি আমি ইংরাজিভাষা অভ্যাস করিয়া আসিতেছি এবং সংস্কৃতভাষা অবগত নহি, সুতরাং এই পুস্তকের অনেক স্থানে যে ইংরাজি গ্রন্থকারদিগের ভাবসঙ্কলন এবং সংস্কৃতভাষার অনভিজ্ঞতা-দোষ লক্ষিত হইবে তাহা বিচিত্র নহে।” হেমবাবু, মিল্টনের অনুসরণ করিয়া থাকুন বা না থাকুন, তিনি এ অংশেও যে স্বকীয় কবিত্বশক্তির বিশেষ পরিচয় দিয়াছেন, তাহা পাঠমাত্রেই সহৃদয় ব্যক্তি বুঝিতে পারিবেন। “নিবিড়ধূম্রল ঘোর” সেই পাতালপুরীর মধ্যে, সেই দীপ্তিশূন্য অমরগণের দীপ্তিশূন্য সভা—অল্পশক্তির সহিত বর্ণিত হয় নাই। একটি শ্লোক বিশেষ ভয়ঙ্কর—
চারি দিকে সমুত্থিত অস্ফুট আরাব
ক্রমে দেব-বৃন্দমুখে ফুটে ঘন ঘন,
ঝটিকার পূর্বে যেন ঘন ঘনচ্ছ্বাস
বহে যুড়ি চারি দিক আলোড়ি সাগর।
ক্রমে দেব-বৃন্দমুখে ফুটে ঘন ঘন,
ঝটিকার পূর্বে যেন ঘন ঘনচ্ছ্বাস
বহে যুড়ি চারি দিক আলোড়ি সাগর।
স্বর্গভ্রষ্ট দেবগণ সেই তমসাচ্ছন্ন, ভীমশব্দপূর্ণ সভাতলে বসিয়া, পুনর্বার স্বর্গ আক্রমণের পরামর্শ করিতে লাগিলেন। দেবমুখে সন্নিবেশিত বাক্যগুলিতে একটি অর্থ আছে; বোধ করি সকলেই টিপ্পনীতে তাহা বুঝিতে পারিবেন। অধিক উদ্ধৃত করিবার আমাদিগের স্থান নাই; উদাহরণস্বরূপ তিনটি শ্লোক উদ্ধৃত করিতেছি।
“ধিক্ দেব! ঘৃণাশূন্য, অক্ষুব্ধ-হৃদয়,
এত দিন আছ এই অন্ধতমপুরে;
দেবত্ব, বিভব, বীর্য, সর্ব তেয়াগিয়া
দাসত্বের কলঙ্কেতে ললাট উজ্জ্বলি।
“ধিক্ সে অমরনামে, দৈত্যভয়ে যদি
অমরা পশিতে ভয় কর দেবগণ,
অমরতা পরিণাম পরিশেষে যদি
দৈত্য-পদরজঃ পৃষ্ঠে করহ ভ্রমণ।
এত দিন আছ এই অন্ধতমপুরে;
দেবত্ব, বিভব, বীর্য, সর্ব তেয়াগিয়া
দাসত্বের কলঙ্কেতে ললাট উজ্জ্বলি।
“ধিক্ সে অমরনামে, দৈত্যভয়ে যদি
অমরা পশিতে ভয় কর দেবগণ,
অমরতা পরিণাম পরিশেষে যদি
দৈত্য-পদরজঃ পৃষ্ঠে করহ ভ্রমণ।
“বল হে অমরগণ—বল প্রকাশিয়া
দৈত্যভয়ে এইরূপে থাকিবে কি হেথা?
চির অন্ধকার এই পাতাল প্রদেশে,
দৈত্য-পদ-রজঃ—চিহ্ন বক্ষে সংস্থাপিয়া?”
দৈত্যভয়ে এইরূপে থাকিবে কি হেথা?
চির অন্ধকার এই পাতাল প্রদেশে,
দৈত্য-পদ-রজঃ—চিহ্ন বক্ষে সংস্থাপিয়া?”
এই সর্গে অনেক স্থানে আশ্চর্য কবিত্ব প্রকাশ আছে, তাহা দেখাইবার আমাদিগের অবকাশ নাই। অন্যান্য সর্গ সম্বন্ধে অধিকতর বক্তব্য আছে।
এই দেবসমাজে ইন্দ্র ছিলেন না। তিনি কুমেরু শিখরে নিয়তির আরাধনা করিতেছিলেন। অমরগণ বিনা ইন্দ্রেই পুনর্যুদ্ধ অভিপ্রেত করিলেন।
দ্বিতীয় সর্গ ইন্দ্রালয়ে। প্রথম সর্গে রৌদ্র ও বীর রসের তরঙ্গ তুলিয়া কুশলময় কবি সহসা সে ক্ষুব্ধ সাগর শান্ত করিলেন। সহসা এক অপূর্ব মাধুর্যময়ী সৃষ্টি সম্প্রসারিত করিলেন। নন্দনবনে বৃত্রমহিষী ঐন্দ্রিলা নবপ্রাপ্ত স্বর্গসুখে সুখময়ী—
রতি ফুলমালা হাতে দেয় তুলি,
পরিছে হরিষে সুষমাতে ভুলি
বদন মণ্ডলে ভাসিছে ব্রীড়া।
পরিছে হরিষে সুষমাতে ভুলি
বদন মণ্ডলে ভাসিছে ব্রীড়া।
এই চিত্রমধ্যে বসন্ত-পবনের মাধুর্যের ন্যায় একটি মাধুর্য আছে—কিসের সে মাধুর্য, পবন-মাধুর্যের ন্যায় তাহা অনির্বচনীয়—স্বপ্নবৎ—
করিছে শয়ন কভু পারিজাতে
মৃদুল মৃদুল সুশীতল বাতে
মুদিয়া নয়ন কুসুমে হেলি।
মৃদুল মৃদুল সুশীতল বাতে
মুদিয়া নয়ন কুসুমে হেলি।
এই সুখশয্যায় শয়ন করিয়া, ঐন্দ্রিলা স্বামীর কাছে সোহাগ বাড়াইতে লাগিলেন। তিনি স্বর্গের অধীশ্বরী হইয়াছেন, তথাপি তাঁহার সাধ পূরে না—শচীকে আনিয়া দাসী করিয়া দিতে হইবে। বৃত্রাসুর তাহাতে স্বীকৃত হইলেন। এই কথোপকথন আমাদিগের তত ভাল লাগে নাই। ইন্দ্রজয়ী মহাসুরের সঙ্গে মহাসুরের মহিষী নন্দনে বসিয়া এই কথোপকথন করিতেছেন, গ্রন্থ পড়িতে পড়িতে ইহা মনে থাকে না, মর্ত্যভূমে সামান্যা বঙ্গগৃহিণীর স্বামিসম্ভাষণ বলিয়া কখন কখন ভ্রম হয়।
তৃতীয় সর্গে, বৃত্রাসুর সভাতলে প্রবেশ করিলেন
নিবিড় দেহের বর্ণ মেঘের আভাস,
পর্বতের চূড়া যেন, সহসা প্রকাশ—
পর্বতের চূড়া যেন, সহসা প্রকাশ—
“পর্বতের চূড়া যেন সহসা প্রকাশ” ইহা প্রথম শ্রেণীর কবির উক্তি—মিল্টনের যোগ্য। বৃত্রসংহার কাব্য মধ্যে এরূপ উক্তি অনেক আছে।
—‘বঙ্গদর্শন’, মাঘ ১২৮১, পৃ. ৪৭২-৭৩।
———————-
* বৃত্রসংহার কাব্য। প্রথম খণ্ড। শ্রীহেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় বিরচিত। শ্রীক্ষেত্রনাথ ভট্টাচার্য কর্তৃক প্রকাশিত। কলিকাতা।
* বৃত্রসংহার কাব্য। প্রথম খণ্ড। শ্রীহেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় বিরচিত। শ্রীক্ষেত্রনাথ ভট্টাচার্য কর্তৃক প্রকাশিত। কলিকাতা।