জ্ঞান সম্বন্ধে দার্শনিক মত

ন্যায়দর্শনের সঙ্গে বাঙ্গালি মাত্রেরই একটি বিশেষ সম্বন্ধ আছে। যদি কেহ আমাদিগকে বলে যে, তোমরা এত বড়াই কর, কিন্তু কোন্ বিষয়ে তোমাদের পূর্বপুরুষেরা পৃথিবীবাসী অন্যান্য জাতির অপেক্ষা গৌরব লাভ করিয়াছিলেন, তাহা হইলে, আমরা আর কিছু বলিতে পারি বা না পারি, ন্যায়শাস্ত্রের উল্লেখ করিতে পারি। ইহাই বাঙ্গালিদিগের জাতীয় গৌরব। ভারতবর্ষীয় প্রত্নতত্ত্বের যতই গাঢ়তর অনুসন্ধান হইতেছে—ততই দেখা যাইতেছে যে সাহিত্যে, দর্শনে, গণিতশাস্ত্রে,—স্থাপত্যে, সঙ্গীতে ব্যবস্থাশাস্ত্রে,—ঐশ্বর্যে, বাহুবলে—একদিন ভারতভূমি, ভূমণ্ডলে রাজ্ঞীস্বরূপা ছিলেন। কিন্তু সে গৌরব বঙ্গদেশের অংশ মগধ কান্যকুব্জাদির ন্যায় নহে। প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্য মধ্যমপ্রকার—জয়দেব গোস্বামী ইহার চূড়া। মানবাদি ধর্মশাস্ত্র বঙ্গীয় নহে। যে স্থাপত্য জন্য ফর্গুসন সাহেব ভারতবর্ষীয়গণকে ভূমণ্ডলে অতুল্য বলিয়াছেন, বঙ্গদেশ অপেক্ষা ভারতবর্ষের অন্যান্যাংশে তাহা প্রচুরতর। যে সঙ্গীতের জন্য সেদিন আলদিস্ সাহেব, ভারতবর্ষকে পৃথিবীশ্বরী বলিয়াছেন, তাহার চালনা বঙ্গদেশে চিরকালই সামান্য প্রকার। আর্যভট্ট, ভাস্করাচার্য প্রভৃতি কেহই বাঙ্গালি নহে। কিন্তু ন্যায়শাস্ত্রে বাঙ্গালিরা অদ্বিতীয়। উদয়নাচার্য বোধ হয়, বাঙ্গালি। রঘুনাম শিরোমণি, মথুরানাথ তর্কবাগীশ, ভবানন্দ সিদ্ধান্তবাগীশ, কৃষ্ণদাস, সার্বভৌম, গদাধর তর্কালঙ্কার, জগদীশ ভট্টাচার্য প্রভৃতি বাঙ্গালি। গৌতম, কণাদ, কোন্ দেশবাসী তাহা নিশ্চিত করিবার কোন উপায় নাই—কিন্তু পরবর্তী প্রধান নৈয়ায়িকদিগের মধ্যে অনেকেই বাঙ্গালি। নবদ্বীপে, ন্যায়শাস্ত্র যেরূপ মার্জিত এবং পরিপুষ্ট হইয়াছিল, এরূপ ভারতবর্ষের আর কোথাও হয় না। নবদ্বীপে, বাঙ্গালির প্রধান কীর্তি ও অকীর্তির জন্মভূমি। নবদ্বীপে ন্যায়শাস্ত্রের অভ্যুদয়, নবদ্বীপে চৈতন্যদেবের অভ্যুদয়—নবদ্বীপে বৈষ্ণব সাহিত্যের আকর—কৃষ্ণচন্দ্রীয় সাহিত্যও নবদ্বীপের নামে খ্যাত—আর, নবদ্বীপেই সপ্তদশ পাঠান কৃত বঙ্গবিজয়!

‘বঙ্গদর্শন’, ফাল্গুন ১২৮১, পৃ. ৪৮৭-৮৮।

—————
* ন্যায় পদার্থ তত্ত্ব। বাঙ্গালা দর্শন। শ্রীহরিকিশোর তর্কবাগীশ প্রণীত। কলিকাতা। গিরিশ বিদ্যারত্ন যন্ত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *