পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পিতৃবিয়োগের পরেও মাধব বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন-শেষ পর্য্যন্ত রহিলেন। তাঁহার অনুপস্থিতিকালে তাঁহার কার্য্যকারকেরা বিষয় রক্ষণাবেক্ষণ করিতে লাগিল। পাঠ সমাপ্ত হইলে হেমাঙ্গিনীকে সঙ্গে লইয়া রাধাগঞ্জে গমনোদ্যত হইয়া শ্বশুরালয়ে আগমন করিলেন।

মাতঙ্গিনী তৎকালে পিত্রালয়ে ছিলেন, এবং রাজমোহনও তথায় উপস্থিত ছিলেন। রাজমোহন সময়ের সুযোগ বুঝিয়া মাধবের নিকট নিজের দুঃখকাহিনী প্রকাশ করিলেন; বলিলেন, “পূর্ব্বে কোনরূপ দিন যাপন করিয়াছি, কিন্তু এক্ষণে কাজকর্ম্ম প্রায় রহিত হইয়াছে; আমাদের সহায় মুরুব্বি মহাশয় ব্যতীত আর কেহ নাই। মহাশয় কুবেরতুল্য ব্যক্তি, অনুগ্রহ করিলে অনেকের কাছে বলিয়া দিতে পারেন।”

মাধব জানিতেন যে, রাজমোহন অতি দুর্নীতস্বভাব, কিন্তু সরলা মাতঙ্গিনী তাহার গৃহিণী হইয়া যে গ্রাসাচ্ছদনের ক্লেশ পাইতেছিলেন ইহাতে মাধবের অন্তঃকরণে রাজমোহনের উপর মমতা জন্মাইল। তিনি বলিলেন, “আমার পূর্ব্বাবধি মানস যে, কোন বিশ্বস্ত আত্মীয়ব্যক্তি হস্তে বিষয়কর্ম্মের কিয়দংশ ভার ন্যস্ত করিয়া আপনি কতকটা ঝঞ্ঝাট এড়াই, তা মহাশয় যদি এ ভার গ্রহন করেন তবে ত উত্তমই হয়।”

রাজমোহন মনে মনে বিবেচনা করিল যে, মাধব যে প্রস্তাব করিতেছিলেন তাহাতে রাজমোহনের আশার অতিরিক্ত ফল হইতেছে; কেন না, সে যদি মাধবের জমিদারীর একজন প্রধান কর্ম্মকারক হইতে পারে, তাহা হইলে তাহার উপার্জ্জনের সীমা থাকিবে না। কিন্তু এক দোষ যে, দেশ ছাড়িয়া যাইতে হইবে।

রাজমোহন উত্তর করিলেন, “আমার প্রতি মহাশয়ের দয়া যথেষ্ট; কিন্তু যদি মহাশয়ের সহিত যাইতে হয়, তা’হলে পরিবার কাহার কাছে রাখিয়া যাই?”

মাধব বলিলেন, “সে চিন্তার প্রয়োজন কি? একই সংসারে দুই ভগিনী একত্র থাকিবেন, মহাশয়ও আমার বাটীতে যেমন ভাবে ইচ্ছা তেমনই ভাবে থাকিবেন।”

এই শুনিয়া রাজমোহন ভ্রূভঙ্গ করিয়া মাধবের প্রতি চাহিয়া সক্রোধে বলিল,-“না মহাশয়, প্রাণ থাকিতে এমন কখনও পারিব না।”

এই বলিয়া রাজমোহন তদ্দণ্ডেই শ্বশুরালয় হইতে প্রস্থান করিল।

পরদিন প্রাতে রাজমোহন প্রত্যাগমন করিল, এবং মাধবকে পুনরায় কহিল, “মহাশয়, সপরিবারে দূরদেশে যাওয়া আমি পারৎপক্ষে স্বীকার নাহি, কিন্তু কি করি, আমার নিতান্ত দুর্দ্দশা উপস্থিত, সুতরাং আমাকে যাইতেই হইতেছে; কিন্তু একটা পৃথক্ ঘর-দ্বারের বন্দোবস্ত না হইলে যাওয়া যায় না।”

যাচকের যাঞ্ছার ভঙ্গী পৃথক্, নিয়মকর্ত্তার ভঙ্গী পৃথক্। মাধব দেখিলেন, রাজমোহন যাচক হইয়া নিয়মকর্ত্তার ন্যায় কথাবার্ত্তা কহিতেছেন; কিন্তু মাধব তাহাতে রুষ্ট না হইয়া বলিলেন, “তাহার আশ্চর্য্য কি? মহাশয় যাইবার পর পক্ষমধ্যে প্রস্তুত বাটী পাইবেন।”

রাজমোহন সম্মত হইল; এবং মাতঙ্গিনীর সহিত মাধবের পশ্চাতে রাধাগঞ্জে যাত্রা করিল।

রাজমোহনের এইরূপ অভিপ্রায় পরিবর্ত্তনের তাৎপর্য্য কি, তাহা প্রকাশ নাই। ফলতঃ এমত অনেকের বোধ হইয়াছিল যে, রাজমোহন এক্ষণে বাটী থাকিতে নিতান্ত অনিচ্ছুক হইয়াছিল; অনিচ্ছার কারণ কি, তাহাও প্রকাশ নাই।

রাধাগঞ্জে উপস্থিত হইয়া মাধব রাজমোহনকে কার্য্যের নামমাত্র ভার দিয়া অতি সুন্দর বেতন নির্দ্ধারণ করিয়া দিলেন; গৃহ নির্ম্মাণ করিতে নিষ্কর ভূমি প্রদান করিলেন; এবং নির্ম্মণ প্রয়োজনীয় তাবৎ সামগ্রী আহরণ করিয়া দিলেন।

রাজমোহন বিনা নিজ ব্যয়ে নিজোপযুক্ত পরিপাটী গৃহ স্বল্পকাল মধ্যে নির্ম্মাণ করিলেন। সেই গৃহের মধ্যেই এই আখ্যায়িকার সূত্রপাত।

রাজমোহন যদিও উচ্চ বেতন-ভোগী হইলেন, কিন্তু মাধব সন্দেহ করিয়া কোনও গুরুতর কার্য্যের ভার দিলেন না।-প্রতিপালনার্থ বেতন দিলেন মাত্র। রাজমোহনের কালক্ষেপনের উপায়াভাব প্রযুক্ত মাধব তাহাকে কৃষকের দ্বারা কর্ষণার্থ বহু ভূমি দান করিলেন; রাজমোহন প্রায় এই কার্য্যেই ব্যাপৃত থাকিতেন।

এইরূপে মাধবের নিকট শোধনাতীত উপকার প্রাপ্ত হইয়া রাজমোহন কোন অংশে কখন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেন না। রাধাগঞ্জে আসা অবধি রাজমোহন, মাধবের প্রতি অপ্রীতিসূচক এবং অপ্রীতিজনক ব্যবহার করিতে লাগিলেন; উভয়ের সাক্ষাৎ সম্ভাবনাদি অতি কদাচিৎ সংঘটন হইত। এইরূপ আচরণে মাধব কখন দৃকপাত করিতেন না-দৃকপাত করিলেও তদ্ধেতু বিরক্তি বা বদান্যতার লাঘব জন্মাইত না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, মাতঙ্গিনী ও হেমাঙ্গিনী পরস্পর প্রাণতুল্য ভালবাসিতেন, তথাপি তাঁহাদের প্রায় সাক্ষাৎ হইত না। হেমাঙ্গিনী কখন কখন স্বামীকে অনুরোধ করিয়া অগ্রজা সন্নিধানে শিবিকা প্রেরণ করিতেন; কিন্তু রাজমোহন প্রায় মাতঙ্গিনীকে ভগিনীগৃহে গমন করিতে দিতেন না। হেমাঙ্গিনী মাধবের স্ত্রী হইয়াই বা কিরূপে রাজমোহনের বাটীতে আসেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *